বৈঠকে আলোচকেরা বলেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাতে কতটুকু সাশ্রয় হচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই।
ডলারের সংকটের এই সময়ে বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিষিদ্ধকরণ অথবা উচ্চ শুল্ক বসানোর পক্ষে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাঁরা বলছেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাতে কতটুকু সাশ্রয় হচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই। তাই সংকট থেকে উত্তরণ না হওয়া পর্যন্ত বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকা করে তা আমদানি নিষিদ্ধ করা অথবা উচ্চ শুল্ক বসানো প্রয়োজন।
প্রথম আলোর আয়োজনে ‘অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও বাজেট প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে একাধিক অর্থনীতিবিদ এই মত দিয়েছেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল শনিবার আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকে ছয়জন অর্থনীতিবিদের পাশাপাশি একজন ব্যাংকার ও একজন ব্যবসায়ী উপস্থিত ছিলেন। গোলটেবিল বৈঠকে সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে পণ্য আমদানিতে শুল্ক সমন্বয়ের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমরাও বিচ্ছিন্নভাবে করছি। তবে এতে কত সাশ্রয় হচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই। আমদানি নিষিদ্ধকরণ হতে পারে। উচ্চ শুল্ক বসতে পারে। অন্যান্য দেশ আমদানি নিষিদ্ধকরণে চলে গেছে। তাই শুল্ক সমন্বয়ের বিষয়টি শক্তভাবে করা উচিত। সমন্বয়ের সময় এইচএস কোডের ছয় ডিজিট পর্যন্ত বিবেচনা করতে হবে। অবশ্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য সুলভ করার উদ্যোগও থাকতে হবে।’
বৈঠকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা সহযোগী তাহরিন তাহরীমা চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও ডলারের দাম বৃদ্ধিতে দেশের অভ্যন্তরে যে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে, সেটি যেন গাড়ির ওপর পড়ে। সেটি যেন পেঁয়াজের ওপর না পড়ে। তাতে দ্রব্যমূল্য নিয়ে গরিব মানুষের দুশ্চিন্তার বদলে ধনীদের দুশ্চিন্তা হয়তো বাড়বে।
এই দুই অর্থনীতিবিদের পাশাপাশি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যাপিডের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক বলেন, অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করতে হবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিদেশ থেকে নমনীয় ঋণ পেতে দর–কষাকষিতে গুরুত্ব দিতে হবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য, মূলধনি যন্ত্র ও কাঁচামালের দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে জাহাজভাড়াও। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) আমদানি খরচ বেড়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। তবে খরচ যে হারে বেড়েছে, রপ্তানি সে হারে বাড়েনি; বরং প্রবাসী আয় কমছে। তাতে আয় দিয়ে ব্যয় মিটছে না। প্রতি মাসে ঘাটতি হচ্ছে ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে আছে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ। এসব সংকটে বাড়ছে ডলারের দাম, আর চাহিদা মেটাতে গিয়ে কমছে রিজার্ভ।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বিলাসবহুল গাড়ি ও ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ নগদ জমার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ সফর বন্ধ করেছে সরকার। এসব উদ্যোগে ডলারের খুব বেশি সাশ্রয় হবে না বলে মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদেরা।
রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার হিসাবে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত দেশে গাড়ি আমদানি হয়নি। এরপর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব মিলিয়ে ২৩ হাজার ২১৮টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। পুরোনো গাড়ির পাশাপাশি দামি নতুন গাড়িও এসেছে এ সময়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে গাড়ি আমদানিতে খরচ হয়েছিল ৯ হাজার ৭০১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে যা বেড়ে হয় ১১ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা।
ডলার-সংকটে পড়েছে পাকিস্তানও। দেশটিতে ডলারের বিনিময় মূল্য এরই মধ্যে ২০০ রুপি ছাড়িয়েছে। সংকট সামাল দিতে বিলাসপণ্য আমদানি নিষিদ্ধের পথ বেছে নিয়েছে পাকিস্তান। ইতিমধ্যে গাড়ি, মুঠোফোন, সিগারেটসহ ৩৮ পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করেছে দেশটি।
গতকালের গোলটেবিলে অংশ নিয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, নিত্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য বিলাসপণ্য সাময়িক সময়ের জন্য একেবারে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। পরিস্থিতির উন্নতি হলে আবার এসব পণ্য আমদানি করা যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।