পিআরআইয়ের ওয়েবিনার

বিদেশি বিনিয়োগ ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে জোর দেওয়ার পরামর্শ

বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা ও মূল্যশৃঙ্খলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে বলে মত দেন বক্তারা।

প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) ভিয়েতনাম বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। দেশটির রপ্তানির ৭২ শতাংশই করছে বিদেশি কোম্পানিগুলো। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে তারা অর্থনৈতিক কূটনীতিতে অনেক জোর দেয়। শিক্ষাব্যবস্থাও তারা সেভাবে গড়ে তুলেছে। কিন্তু সেই তুলনায় বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে আছে।

গতকাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত এক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘ভিয়েতনামের অসাধারণ রপ্তানি সাফল্য: বাংলাদেশ কী শিক্ষা নিতে পারে’ শীর্ষক এই ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার।

বক্তারা বলেন,বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশের কাছে এখনো নিছক বিদেশি মুদ্রার উৎস। এই মনোভাব দিয়ে এখন চলবে না। বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা ও মূল্যশৃঙ্খলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে বলে মত দেন বক্তারা। আর বাণিজ্যকেন্দ্রিক প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি হচ্ছে এফডিআই, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও বৈশ্বিক মূল্যশৃঙ্খলে অংশগ্রহণ।

বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর আত্মসন্তুষ্টি আছে উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, এই সন্তুষ্টি বোধ করার আগে ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করা উচিত। সাদিক আহমেদের উপস্থাপনার প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘সুশাসনের দিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সুশাসন থাকার কারণে ভিয়েতনাম কীভাবে ও কতটা এগিয়ে গেল এবং সুশাসন না থাকার কারণে বাংলাদেশ কীভাবে ও কতটা পিছিয়ে পড়ছে, তার বিশ্লেষণ থাকা প্রয়োজন। স্যামসাং দেশে মোবাইল ফোন কারখানা স্থাপন করতে চেয়েছিল, কিন্তু আলোচনা সফল না হওয়ায় তারা পরবর্তীকালে ভিয়েতনামে চলে যায়। এ নিয়ে সরকারের তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত বলে পরামর্শ দেন রেহমান সোবহান—কেন এই বিনিয়োগ আমরা আনতে পারলাম না।’

প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘আমাদের শিখতে হবে, তারা কীভাবে ভালো করছে, আর আমরা কেন পিছিয়ে আছি।’ পিআরআইয়ের প্রশংসা করে তিনি বলেন, এ ধরনের উদ্যোগ সরকারের জন্য সহায়ক।

অনুষ্ঠানের শুরুতে রপ্তানি বাণিজ্যে ভিয়েতনামের সফলতা নিয়ে উপস্থাপনা দেন পিআরআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ। তিনি দেখান, রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় ভিয়েতনামের স্থান ২৫, যেখানে বাংলাদেশ আছে ৫৬ নম্বর স্থানে। ভিয়েতনামের রপ্তানি বাজার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড়। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় স্থান ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। কিন্তু ভিয়েতনাম শুধু তৈরি পোশাকের মতো শ্রমঘন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল নয়। তারা এখন উচ্চ প্রযুক্তি রপ্তানি করছে, যা এখন তাদের মোট রপ্তানির ৪০ ভাগ। আবার তাদের রপ্তানি গন্তব্যও দু-একটি বাজারনির্ভর নয়। আর এসব সম্ভব হয়েছে মূলত এফডিআইয়ের কারণে।

এফডিআই বাড়াতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ও লজিস্টিক সেবার উন্নতির পাশাপাশি মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারণে কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দেন অ্যাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, এলডিসি উত্তরণের পর সুরক্ষাবাদী থাকার সুযোগ নেই। শুল্কবাধা থাকলে বিনিয়োগও আকর্ষণ করা যায় না। তিনি জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভিয়েতনাম যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছে, তাতে তারা শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে, যেখানে আগে তারা ৯ শতাংশ শুল্ক দিত। আর এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশকে ৯ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। বলাই বাহুল্য, উৎপাদন ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি করে তাকে এই বাধা কাটাতে হবে।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভাষ্যমতে, ভিয়েতনামে লাইসেন্স ও পারমিট এক দরজা থেকেই মেলে, আর বাংলাদেশে নানা দ্বারে ঘুরতে ঘুরতে ৯ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়, সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর জানান। ‘ভিয়েতনামে আপনারা কেন বিনিয়োগ করতে আগ্রহী’—এক বিদেশি বিনিয়োগকারীরাকে নাসিম মঞ্জুর এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে জবাবে তিনি বলেন, ‘ভিয়েতনামে দুই থেকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে শুল্কছাড় মেলে। বাংলাদেশে তিন–চার সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যায়।’

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক বলেন, অর্থনৈতিক বহুমুখীকরণে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণে জোর দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে যেতে হবে আমাদের।’

ভিয়েতনাম অনেক কৌশলী পদ্ধতিতে রপ্তানি বাণিজ্যে সফলতা পেয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তারা। এ ছাড়া কখন কোথায় প্রণেদানা দিতে হবে, সে ব্যাপারেও তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নেয় বলে উল্লেখ করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

আলোচনার সক্ষমতা ও অর্থনৈতিক কূটনীতি নিয়ে আলোকপাত করেন জাতিসংঘের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট নাজনীন আহমেদ। ভিয়েতনাম ২০০৮ সালে যে আর্থসামাজিক উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করে, তার বড় একটি অংশ ছিল অর্থনৈতিক কূটনীতি। আলোচনার সময় অপর পক্ষকে কীভাবে নিজের যুক্তির পক্ষে নিয়ে আসা যায়, সেটা এক কৌশল। এই কৌশল সহজাতভাবে মানুষ নিয়ে আসে না। শিখতে বা আয়ত্ত করতে হয় এটা। শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই তা থাকা উচিত।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাণিজ্য বা রপ্তানিনির্ভর প্রবৃদ্ধির জন্য আঞ্চলিক ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো কারও সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেনি। দেশের সুরক্ষামূলক গড় শুল্ক হার ২৭ শতাংশ। এত উচ্চ শুল্ক থাকলে এফডিএ আকর্ষণ করা যাবে না। আর রপ্তানি সফলতার জন্য মুদ্রার বিনিময় হারও বাস্তবসম্মতভাবে নির্ধারণ করা জরুরি বলে তাদের মত।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন এমসিসিআই সভাপতি নিহাদ কবির, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রহমান, সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রমুখ।