ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের বৃহস্পতি এখন যেন তুঙ্গে। চলতি মাসেই এই মুদ্রার দাম বেড়েছে প্রায় ৮৩ শতাংশ। গতকাল এই প্রতিবেদন লেখার সময় বিটকয়েনের দাম ছিল ৩৪ হাজার ৭৯৭ মার্কিন ডলার। দিনের মধ্যভাগে বিটকয়েনের দাম ইতিহাসে এই প্রথম ৩৫ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। এর আগে গত রোববার বিটকয়েনের দাম ৩৪ হাজার ডলারে উঠেছিল।
করোনা মহামারি শুরুর পর থেকেই যেন বিটকয়েনের দাম বেড়ে চলেছে। ২০২০ সালে ডিজিটাল মুদ্রার দাম বেড়েছে ৩০০ শতাংশ। শুধু বিটকয়েন নয়, অন্যান্য ডিজিটাল মুদ্রার দামও বেশ বাড়ছে। বিটকয়েনের পর সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত ডিজিটাল মুদ্রা হচ্ছে ইথেরিয়াম। ২০২০ সালে এই মুদ্রার দাম বেড়েছে ৪৬৫ শতাংশ।
২০১৩ সালে প্রথম নজরে আসে বিটকয়েন। সে বছর বিটকয়েনের দাম ওঠে সর্বোচ্চ ৪০০ ডলারে। ২০১৭ সালে এসে এ মুদ্রায় বড় পরিবর্তন আসে, তাতে দাম উঠে যায় ২০ হাজার ডলারে। তবে সেই দাম কমতেও খুব একটা সময় লাগেনি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এসে দাম কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ২০০ ডলারে। এমনকি ২০২০ সালের অক্টোবর মাসেও এ মুদ্রার দাম ছিল ১০ হাজার ৬০০ ডলার। এরপর থেকেই রকেট গতিতে বাড়তে শুরু করে দাম। তাতে ৩ জানুয়ারি প্রতিটি মুদ্রার দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ডলার। পরদিনই তা আবার কমে আসে।
বিটকয়েনের বাজার গত কয়েক বছরে বড় হয়েছে। বাজারে ইথেরিয়ামের মতো নতুন মুদ্রাও যুক্ত হয়েছে, চালু হয়েছে বিটকয়েন এক্সচেঞ্জও।
গত সাত-আট বছরে বিটকয়েনের ইকোসিস্টেম বা বাজার ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়েছে। বাজারে নতুন নতুন মুদ্রা যেমন এসেছে, তেমনি অনলাইনে বিটকয়েন এক্সচেঞ্জও চালু হয়েছে। এতে বিনিয়োগ করে বিপুল অর্থের মালিকও হয়েছেন বহু মানুষ। দিন দিন এটির জনপ্রিয়তা এতই বাড়ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ফুটবল লিগের খেলোয়াড় রাসেল ওকুংকে বিটকয়েনে সম্মানী পরিশোধ করা হচ্ছে ক্লাবের পক্ষ থেকে।
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই এখন বিটকয়েনের আইনি স্বীকৃতি আছে। তবে বাংলাদেশ, মিসর, আলজেরিয়া, মরক্কো প্রভৃতি দেশে বিটকয়েন এখনো নিষিদ্ধ। কিছু কিছু দেশে সরাসরি নিষিদ্ধ না হলেও বিটকয়েন ব্যবহারে নানা রকম বিধিনিষেধ আছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সম্পদ হিসেবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিটকয়েনের দিকে ঝুঁকছে। বিটকয়েন ব্যবহারকারীরা মনে করছেন, সম্পদ হিসেবে সোনার জায়গা নিয়ে নিচ্ছে বিটকয়েন। বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, মার্কিন ডলারের দাম ২০২১ সালে কমতে পারে—এই আশঙ্কায় বিটকয়েনের দাম এ বছর আরও বাড়তে পারে। করোনা মহামারির শুরুতে বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে নিশ্চয়তা খুঁজে পেতে ডলারের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এতে ডলারের মূল্য বেড়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে বেশ কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজের কারণে ডলারের মূল্য পড়ে যায়। পাশাপাশি পে পলের মতো লেনদেন বা পেমেন্ট গেটওয়ে এখন ডিজিটাল মুদ্রা গ্রহণ করতে শুরু করায় বিটকয়েনের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে গেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ বিটফিনেক্সের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা পাওলো আরডিওনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘ডিজিটাল মুদ্রার বাজারে এত তেজি ভাব আগে কখনো দেখা যায়নি। ফলে বিটকয়েনের মালিকদের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল।’
সাতোসি নাকামোতো নামের প্রতিভাবান জাপানি এক নাগরিক ২০০৮ সালের শেষে জাপানে কম্পিউটারনির্ভর একটি লেনদেন ব্যবস্থা তৈরি করেন। যেটি প্রথাগত মুদ্রার বিকল্প ছিল না। তিনি এমন একটা লেনদেন ব্যবস্থা তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যেখানে লেনদেনের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের কোনো হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হবে না, হিসাব থাকবে কম্পিউটারে। আর এই লেনদেনের হিসাব রাখতে একটা সূচকের ব্যবহার করা হবে। এই সূচকই বর্তমানে বিটকয়েন নামে পরিচিত, যা ডিজিটাল মুদ্রা হিসেবেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। সাতোসি নাকামোতো ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থাটি তৈরি করেন ব্লক চেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা শাখা–প্রশাখা যুক্ত হয়েছে।
বিটকয়েনের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি ছাড়াই এটি লেনদেন করা যায়। কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের নজরদারির বাইরে গিয়ে ভালো কাজ করা যাবে, এই ছিল সাতোসির আশা। এই যে পৃথিবীজুড়ে দুই পক্ষের মধ্যে সরাসরি লেনদেনের একটি ব্যবস্থা তৈরি হয়ে গেল, তার সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ফল হলো কালোবাজারি। লেনদেন যেহেতু দুই পক্ষের মধ্যেই হয়, তাই তা ধরাও মুশকিল। ধরা যাক, আপনি বিটকয়েন কিনলেন কারও কাছ থেকে, প্রচলিত মুদ্রার বিনিময়ে। যার কাছ থেকে কিনলেন, তার লেজারে বিটকয়েন কমে গেল। তৈরি হলো আপনার লেজার, যে কয়টা বিটকয়েন কিনলেন, তা সেখানে জমা হলো। যাঁরা বিটকয়েন কেনেন, তাঁদের বলা হয় ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনার, বিক্রির সময় বিক্রেতার সিলমোহর লাগে। তবে কোনো সরকারি সংস্থার কোনো স্বীকৃতির দরকার হয় না। এ কারণে বিটকয়েনের মাধ্যমে অপরাধমূলক কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
তবে বিটকয়েন বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে সোনার চেয়েও বেশি অস্থির। কারণ, হিসেবে বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিটকয়েনের কোনো মৌল ভিত্তি নেই। ফলে এটির বাজারে বুদ্বুদ তৈরি হলে তা খুব সহজেই ফেটে যাবে। তাতে পুঁজি হারাতে পারেন অনেকে। তাই এটি কখনো সোনার বিকল্প হতে পারে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের বড় একটি অংশ।