বাংলাদেশ-ভারত

বাণিজ্য বাড়াতে নতুন চুক্তি

বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সিইপিএ) নামে নতুন এক চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে দুই দেশ। ছয় মাসের মধ্যে সমীক্ষা সম্পন্ন হবে।

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট সার্কের আট সদস্যদেশের ছয়টিতে বাংলাদেশ যা রপ্তানি করে, এক ভারতেই বাংলাদেশ রপ্তানি করে তার ছয় গুণ বেশি। আবার চীনের পর বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে ভারত থেকেই।

এ রকম এক অবস্থায় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সিইপিএ) নামে নতুন এক চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে দুই দেশ। মূলত স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের দিক থেকেই এই চুক্তির প্রস্তাবটি ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের বাণিজ্য চুক্তির পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন পরিবহনব্যবস্থা চালু হলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য আরও বাড়বে।

শুল্কমুক্ত সুবিধার বদৌলতেই প্রথমবারের মতো দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। তবে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার পর যে শুল্কমুক্ত সুবিধাটা থাকবে না, বাংলাদেশকে এখন থেকেই এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে হবে এবং দুই দেশ মিলে একটা বিকল্প ব্যবস্থা বের করতেই হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডির বিশেষ ফেলো

চলতি মাসেই বিশ্বব্যাংক ‘সমৃদ্ধির জন্য আন্তযোগাযোগ: দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাঞ্চলের সমন্বিত পরিবহনব্যবস্থা চালুর চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের মাত্র ১০ শতাংশ হয় ভারতের সঙ্গে। আর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের হয় মাত্র ১ শতাংশ। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হলেই ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে ১৮২ শতাংশ, আর বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি বাড়বে ১২৬ শতাংশ। আর নিরবচ্ছিন্ন পরিবহনব্যবস্থা চালু হলে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে ২৯৭ শতাংশ, বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি বাড়বে ১৭২ শতাংশ।

নতুন চুক্তিতে কী থাকবে

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ-ভারত সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সিইপিএ) করার আলোচনা শুরু হয়েছে গত বছর। আগামী ছয় মাসের মধ্যে সিইপিএর একটি সমীক্ষা হবে। সমীক্ষা করতে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটকে (বিএফটিআই) ৯০ লাখ টাকাও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীনকে প্রধান করে এ ব্যাপারে ১০ সদস্যের একটি উপদেষ্টা কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সচিবালয়ে গত মঙ্গলবার এ উপদেষ্টা কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ রপ্তানি গন্তব্যস্থলের মধ্যে ভারতের অবস্থান নবম।

সূত্রগুলো জানায়, বৈঠকে বিএফটিআই একটি সূচনা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে। ভারতও একই ধরনের একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। সমীক্ষার মধ্যে কী কী বিষয় উল্লেখ থাকবে, সূচনা প্রতিবেদনে এ বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়েছে। বিএফটিআইয়ের সমীক্ষার মধ্যে থাকবে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার সব ধরনের চুক্তির বিশ্লেষণ, সড়ক, নৌ, রেল ও আকাশ যোগাযোগের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা, স্বাধীনতার পর থেকে উভয় দেশের বাণিজ্য পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণ ইত্যাদি।

বৈঠক সূত্রে আরও জানা গেছে, শুল্ক ও অশুল্ক বাধার কারণে উভয় দেশের বাণিজ্য কীভাবে ব্যাহত হচ্ছে, শুল্কস্টেশনগুলোকে কীভাবে আরও বেশি কার্যকর করা যায় এবং বাণিজ্য বৃদ্ধিতে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য এলাকাকে (সাফটা) কীভাবে আরও কাজে লাগানো যায়—এসব বিষয়ও সমীক্ষায় থাকবে। উপদেষ্টা কমিটির পরের বৈঠক বসবে আগামী মাসের শেষ সপ্তাহে। দুই দেশের আলাদা সমীক্ষা হওয়ার পর তা নিয়ে দর-কষাকষি হবে। ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করা হবে। এরপর হবে চুক্তি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এর আগে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারত সিইপিএ করেছে ১৯৯৮ সালেই। এরপর সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ২০০৫ সালে; দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ২০০৯ সালে; নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে করেছে ২০১০-১১ সালে এবং থাইল্যান্ডের সঙ্গে ভারত সিইপিএ করেছে ২০১৫ সালে।

বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীন এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। বড় দেশ হিসেবে তারা আমাদের একটু বেশি দেবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ভারতে রপ্তানিতে একটু ধাক্কা আসতে পারে। এ জন্যই সিইপিএ করা হচ্ছে। ছয় মাসের মধ্যে সিইপিএর সমীক্ষাটা শেষ হবে। এরপর হবে উভয় দেশের দর-কষাকষি। সিইপিএ হয়ে গেলে দেশটিতে রপ্তানি সুবিধা পাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থাটিও তৈরি হয়ে যাবে।’

১০ বছরে রপ্তানি দ্বিগুণ

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে বিদায়ী অর্থবছরে পাকিস্তানে ৫ কোটি ৫ লাখ, নেপালে ৪ কোটি ৬০ লাখ, শ্রীলঙ্কায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ, আফগানিস্তানে ৫৭ লাখ ৬৬ হাজার, মালদ্বীপে ৫১ লাখ ৩৬ হাজার এবং ভুটানে ৪৩ লাখ ৫৬ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ সার্কের সদস্য অন্য ছয় দেশে বাংলাদেশ রপ্তানি করে ১৫ কোটি ডলারের একটু বেশি। সে হিসাবে গত অর্থবছরে এক ভারতেই বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ছয় গুণ বেশি।

সার্কের সদস্য ছয় দেশে যা রপ্তানি হয়, এক ভারতেই হয় তার ছয় গুণ বেশি।

বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি গন্তব্যস্থল হিসেবে ভারতের অবস্থান এখন নবম। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসের রপ্তানি হিসাব বলছে, ভারতে রপ্তানি গতবারের চেয়েও ছাড়িয়ে যাবে এবার। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ১২৪ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ১০৯ কোটি ডলারের পণ্য। আর ৮৬ কোটি ডলারের পণ্য ভারতে রপ্তানি হয়েছে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের সাত মাসে।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০ বছর আগের তুলনায় ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি দ্বিগুণ ছাড়িয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরেও ভারতে ৫১ কোটি ২৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। মূলত ২০১১ সালে বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলে দেশটিতে রপ্তানি বাড়তে থাকে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এক রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসার পর থেকেই এ শুল্কসুবিধা কার্যকর হয়।

ভারতে রপ্তানি যেমন বাড়ছে, দেশটি থেকে আমদানিও বাড়ছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে ভারত থেকে ৪৫৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশটি থেকে সেই আমদানি বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬২ কোটি ডলার এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আরও কমে ৭৬৪ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছর আগে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ব্যবধান ছিল ৪০৭ কোটি ডলারের। মাঝখানে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যবধানটা ৭৭৫ কোটি ডলারে পৌঁছালেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা নেমে আসে ৪৬৭ কোটি ডলারে। দেখা যায়, ভারত থেকে আমদানি বাড়লেও দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য আকারে বৃদ্ধির কারণে বাণিজ্য ব্যবধানটা তেমন বাড়ছে না। বাণিজ্য ব্যবধান প্রায় ১০ বছরের আগের জায়গাতেই আছে।

ভারতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য হচ্ছে তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, মাছ, কোমল পানীয়, তামা, ভোজ্যতেল ইত্যাদি। আর ভারত থেকে আমদানি করা হয় চাল, কাঁচা তুলা, পেঁয়াজ, মোটরগাড়ি, বয়লার, যন্ত্রপাতি, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, ইলেকট্রনিক পণ্য, লোহা ইত্যাদি।

ভারতীয় ঋণ ও অনুদান

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার ভারত। দেশটি ২০১০ থেকে ১০ বছরে ৪৬টি প্রকল্পের বিপরীতে তিনটি লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) মাধ্যমে ৭৩৬ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

সড়ক, রেলপথ, নৌপরিবহন ও বন্দর, বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ও কারিগরিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ এ ঋণ পাওয়ার কথা। তবে ভারতের এক্সিম ব্যাংক এ পর্যন্ত ঋণ ছাড় দিয়েছে ৮০ কোটি ডলারের কাছাকাছি।

বাণিজ্য ব্যবধান ১০ বছর আগে ছিল ৪০৭ কোটি, বর্তমানে ৪৬৭ কোটি ডলার।

প্রথম এলওসির আওতায় ২০১০ সালে ভারতের সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের চুক্তি হয়। পরে এ অর্থ থেকেই ১৪ কোটি ডলার পদ্মা সেতু প্রকল্পে অনুদান দেয় ভারত। বাকি ৮৬ কোটি ডলার দিয়ে ১৫টি প্রকল্প নেওয়া হয়, যার মধ্যে ১২টিই বাস্তবায়িত।

২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসেন। তখন তিনি ২০০ কোটি ডলারের দ্বিতীয় এলওসি ঘোষণা করেন। পরে এ বিষয়ে উভয় দেশের চুক্তি হয়। এই অর্থের মাধ্যমে নেওয়া হয় ১৫টি নতুন প্রকল্প। যতটুকু ছাড় হয়েছে, তার মাধ্যমে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় হয় তৃতীয় এলওসির চুক্তি। এটি আরও বড় অর্থাৎ ৪৫০ কোটি ডলারের। এ দফায় প্রকল্প নেওয়া হয় আরও ১৬টি।

সামগ্রিক বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শুল্কমুক্ত সুবিধার বদৌলতেই প্রথমবারের মতো দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। তবে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার পর যে শুল্কমুক্ত সুবিধাটা থাকবে না, বাংলাদেশকে এখন থেকেই এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে হবে এবং দুই দেশ মিলে একটা বিকল্প ব্যবস্থা বের করতেই হবে।

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি বা সিইপিএ হতে পারে সেই বিকল্প ব্যবস্থা, যার মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও যোগাযোগ—এ তিনের সংশ্লেষ থাকতে পারে। তবে প্রস্তুতি থাকতে হবে যে সিইপিএ হলে বাংলাদেশকেও কিছু ছাড় দিতে হবে।