আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। বর্তমান বাজারদরে (৮৫ টাকায় প্রতি ডলার) এর পরিমাণ ৬৪ হাজার কোটি টাকা।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) গতকাল মঙ্গলবার এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনটিতে ১৩৫টি উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশের গত ১০ বছরের (২০০৮-২০১৭) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মূল্য ঘোষণার গরমিল দেখিয়ে কীভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়, সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি ৩৫টি উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনামূলক চিত্রও দেওয়া হয়েছে। একটি দেশ অন্য দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি করার সময় প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে কমবেশি দেখানো হয়। মূল্য ঘোষণার বাড়তি অংশের অর্থ বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়। এমন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জিএফআই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০১৪,২০১৬ ও ২০১৭ সালের তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয়নি ওই প্রতিবেদনে। বাংলাদেশের বাকি সাত বছরের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অর্থ পাচারের হিসাব দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছরের গড় অর্থ পাচারের হিসাবে ওই ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৩৩ তম। এ দেশে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে মূল্য ঘোষণার গরমিল দেখিয়ে টাকা পাচার হয় বলে অভিযোগ আছে। ইদানীং এমন কিছু ঘটনাও উদ্ঘাটন করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য সব দেশের যত আমদানি-রপ্তানি হয়, তাতে গড়ে ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ বা প্রায় ১৮ শতাংশের মূল্য ঘোষণায় গরমিল থাকে।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদন বলছে, ২০০৮ সালের পরে বাংলাদেশে এভাবে মূল্য ঘোষণায় গরমিল দেখিয়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৫১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিদেশে চলে গেছে। ২০০৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫২৮ কোটি ডলার। এ ছাড়া ২০০৯ সালে ৪৯০ কোটি ডলার, ২০১০ সালে ৭০৯ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৮০০ কোটি ডলার, ২০১২ সালে ৭১২ কোটি ডলার ও ২০১৩ সালে ৮৮২ কোটি ডলার বিদেশে গেছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী—প্রায় সবার ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাঁরা টাকা সরানোর চেষ্টা করেন। তাঁদের মধ্যে এ দেশে বিনিয়োগ বা টাকা রাখায় কোনো আস্থা নেই।
আহসান এইচ মনসুরের মতে, সুশাসন না থাকলে টাকা পাচার হবেই। টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িতরা সমাজের উঁচু স্তরের লোক। দেশে টাকা ধরে রাখার জন্য তাঁদের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। সবার আগে দেশকে ভালো করতে হবে।
জিএফআই এবারের প্রতিবেদনে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে মূল্য ঘোষণার গরমিলের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধকে সরাসরি অর্থ পাচার বলেনি। এভাবে মূল্য ঘোষণার গরমিল কী পরিমাণ, তা নির্ধারণ করেছে জিএফআই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৬ সালে ইকুয়েডর ২ কোটি ডলারের কলা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে বলে তাদের তথ্য-উপাত্তে দেখানো হয়েছে। কিন্তু ইকুয়েডর থেকে ওই বছর দেড় কোটি ডলারের কলা আমদানি করেছে বলে যুক্তরাষ্ট্র দেখিয়েছে। এর মাধ্যমে মূল্য ঘোষণার গরমিল হলো ৫০ লাখ ডলার। জিএফআই বলছে, ৩৫টি উন্নত দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ দেশের ব্যবসায়ীরা তুলনামূলক কম মিথ্যা ঘোষণা দেন। এই হার ওই সব দেশের সঙ্গে মোট বাণিজ্যের ১৪ শতাংশের কিছুটা বেশি।
বাংলাদেশ সম্পর্কে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে গড়ে ৩২৯ ডলার ওই সব উন্নত দেশে চলে গেছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৫৮ কোটি ডলার। ২০০৮ সালে এভাবে উন্নত দেশে গেছে ২৫৫ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের তদন্তেও বেশ কিছু টাকা পাচারের তথ্য এসেছে। আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিকট পাঠিয়েছি। এখন তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধে আমরা একটি নীতিমালা করেছি। ব্যাংকগুলোকে তা মেনে চলার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ জিএফআই যে প্রতিবেদন দেয়, তাতে হিসাবের অনেক গরমিল দেখা গেছে বলে তিনি জানান।
শীর্ষে চীন
আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে অর্থ পাচারে শীর্ষে আছে চীন। ২০০৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে প্রতিবছর গড়ে ৪৮ হাজার ২৩৯ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা রাশিয়া থেকে বছরে পাচার হয় ৯ হাজার ২৬৩ কোটি ডলার। আর মেক্সিকো থেকে ৮ হাজার ১৫১ কোটি ডলার বিদেশে গেছে।
প্রতিটি দেশ জাতিসংঘ কমট্রেডে নিজেদের বাণিজ্যের তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে। সেই তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে জিএফআই বিদেশে চলে যাওয়া অর্থের হিসাব করে থাকে। ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশ ও ৩৫টি উন্নত দেশের মধ্যে যে বাণিজ্য হয়েছে, তাতে প্রায় ৮ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ মূল্য ঘোষণায় গরমিল হয়েছে।