ধানের দাম পাননি এবার কৃষক। ব্যাংকের পাশাপাশি শেয়ারবাজারেও আছে সংকট। তহবিলের অভাবে তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছেন না সেভাবে। অন্যদিকে কর বাড়তে পারে—এ শঙ্কায় সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকেরা। বাজেট সামনে রেখে এসব খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাধারণ মানুষ জানিয়েছেন তাঁদের প্রত্যাশার কথা। তাই নিয়ে এ আয়োজন
তরুণদের উৎসাহিত করতে হবে
আরিফ নিজামী, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রেনিউর ল্যাব লিমিটেড
দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তা সন্তোষজনক। এটির ধারাবাহিকতার জন্য উদ্যোক্তা ও ব্যবসা-বাণিজ্য খাতকে সমর্থন দিতে হবে। সরকার গত বছর তথ্যপ্রযুক্তির পণ্য রপ্তানির জন্য নগদ সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিলেও বিভিন্ন কারণে তাআর হয়ে ওঠেনি। সরকার যদি প্রণোদনার মাধ্যমে তরুণ স্টার্টআপ বা ব্যবসা শুরুর উদ্যোগকে উৎসাহিত করে, তাহলে তা দেশের অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বর্তমানে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে শতকরা মাত্র ১৭ ভাগ নারী কাজ করেন। এই সংখ্যাটি বাড়ানোর ব্যাপক সুযোগ আছে। সে জন্য সরকার বিভিন্নভাবে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে। এ ছাড়া ক্রাউড-ফান্ড, পি-টু-পি লেন্ডিং, এঞ্জেল ইনভেস্টমেন্ট ইত্যাদি তহবিল বিদেশ থেকে আনতে সরকার বৈধতা দেয়, তাহলে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি হবেন। বর্তমানে তরুণদের অনেকেই নিত্যনতুন ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করছেন, কিন্তু অর্থায়নের কোনো ব্যবস্থা না থাকার জন্য
এগিয়ে যেতে পারছেন না। সে জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা দরকার।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখেছি, আগামী অর্থবছরের বাজেটে স্টার্টআপদের জন্য ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল থাকবে। এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। সেই তহবিলের টাকা যেন প্রকৃত উদ্যোক্তা পান, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে তহবিলের অর্থ পাওয়ার প্রক্রিয়া যেন সহজ ও স্বচ্ছ হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, অর্থ পেতে যদি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকে কিংবা দিনের পর দিন ঘুরতে হয়, তাহলে তরুণেরা নিরুৎসাহিত হবেন।
কৃষকের ক্ষতিপূরণ রাষ্ট্রকেই দিতে হবে
জয়নাল আবেদিন, কৃষক, আলিপুর, মহাদেবপুর, নওগাঁ
বাজেটের মাধ্যমে আমাদের মতো সাধারণ কৃষকের তো ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। সব সময় বলা হয়, কৃষকের উন্নয়ন হলেই দেশের উন্নয়ন হবে। অথচ প্রতিবছর বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমছে। কৃষি উপকরণের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সে জন্য উৎপাদনে খরচ বাড়ছে। আর কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কৃষকেরা ঘাম ঝরিয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদন করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখলেও তাঁরা কখনোই পুরস্কার পাননি। উল্টো লোকসান গুনতে গুনতে কৃষকেরা দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে।
আমি একজন মাঝারি কৃষক। চলতি বোরো মৌসুমে ২০ বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেছিলাম। বীজতলা তৈরি থেকে শুরু করে ধান মাড়াই পর্যন্ত প্রতি বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। ধানের দাম না থাকায় নিজের জমিতে প্রতি বিঘায় ধান আবাদ করে আমার লোকসান হয়েছে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। আমার মতো সারা দেশের লাখ লাখ কৃষক নিঃস্ব হয়ে গেছে। কৃষকের এই ক্ষতিপূরণ দেবে কে? অবশ্যই এটা রাষ্ট্রকে দিতে হবে। বাজেটে অবশ্যই কৃষি খাতে ভর্তুকি বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষকেরা ক্ষতির সম্মুখীন হলে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত।
সাধারণ মৌসুমের শুরুতেই ১৫-২০ দিনের মধ্যেই ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি কৃষকেরা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ধান বিক্রি করে ফেলেন। কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সে জন্য প্রতিটি মৌসুমের শুরুতেই খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করতে হবে। খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য অবকাঠামো বাড়ানোর প্রয়োজন হলে সে ক্ষেত্রে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত বলে আমি করি।
বাজেট এলেই মনে একটা শঙ্কা জাগে
শাহানাজ আক্তার, বসুন্ধরা মহিলা শাখার ব্যবস্থাপক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক (এসবিএসি)
বাজেট এলেই মনে একটা শঙ্কা জাগে, এই বুঝি আবারও করের বোঝা চাপল। আমার মনে হয়, আমরা চাকরিজীবীরাই সবচেয়ে বেশি কর পরিশোধ করি। নতুন ভ্যাট আইন হচ্ছে। জানি না কী হবে। আসলে ব্যবসায়ীরা তো ভ্যাট দেন না। গ্রাহকের থেকেই এটা নেওয়া হয়। অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, করের পরিমাণ না বাড়িয়ে ক্ষেত্র বাড়ানো হোক।
আমার প্রত্যাশা, সরকারি কর্মকর্তাদের মতো বেসরকারি খাতের কর্মকর্তাদের জন্যও পেনশনব্যবস্থা চালু করা হবে। ব্যাংকার হিসেবে আমার দাবি, ঋণখেলাপিদের সরকার যেন কোনো ধরনের ছাড় না দেয়। তাঁদের যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক না কেন, তাঁরা ঋণ শোধ করবেন না। বরং তাঁদের নাম–পরিচয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করা উচিত, যাতে সামাজিকভাবে তাঁরা বয়কট হন। ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেওয়া হবে—এমন ঘোষণার ফলে অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে ব্যাংক খাতে যে অবস্থা বিরাজ করছে, সেটা কোনোভাবে স্বস্তিদায়ক নয়। আমানত সংগ্রহে আমরা একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছি। সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদহার না কমালে ব্যাংকিং খাতের এই প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে বলে মনে হয় না।
একজন নারী হিসেবে বলব, নারী উদ্যোক্তাদের আরও সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানে যে বিধান আছে, ব্যাংকগুলো সেটা যথাযথভাবে পালন করছে কি না, তা তদারক করা দরকার। এ ছাড়া নারী চাকরিজীবী, উদ্যোক্তাসহ সব শ্রেণির নারীর জন্য পরিবহনব্যবস্থা নিশ্চিত করার জোর দাবি জানাই।
শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানি চাই
পারভেজ সাজ্জাদ, শেয়ারবাজারে ফরেন ইনভেস্টর রিলেশন, বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত
বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) যে প্রবৃদ্ধি, শেয়ারবাজারে তার প্রতিফলন খুবই কম। জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধন অনেক কম। এর অন্যতম কারণ দেশের বড় বড় ও ভালো মানের কোম্পানি বাজারে নেই। তাই এ ধরনের কোম্পানিকে বাজারে আনতে বাজেটে প্রণোদনা ও কর ছাড়ের ব্যবস্থা রাখা হবে, এ প্রত্যাশা করছি। সাধারণ মানুষ যাতে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হন, সে জন্য পুঁজিবাজারকে বিনিয়োগের আকর্ষণীয় জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ভালো কিছু কোম্পানিকে বাজারে আনা গেলে তাতে নতুন নতুন বিনিয়োগকারীও বাজারে আসবেন। তবে সঞ্চয়পত্রের উচ্চ মুনাফার হার থাকলে সাধারণ মানুষ শেয়ারবাজারের প্রতি আকৃষ্ট হবে না।
বর্তমানে বাজারে যেসব সাধারণ বিনিয়োগকারী রয়েছেন, তাঁদের জন্য করমুক্ত লভ্যাংশ আয়ের সীমা ২৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা দরকার। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ও আর্থিক প্রতিবেদন ছাড়া সব ধরনের তথ্য যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সহজে জানতে পারেন, তার ব্যবস্থা থাকা উচিত। কারণ একটি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন থেকে ওই কোম্পানি সম্পর্কে অর্ধেক তথ্য জানা যায়। বাকি তথ্য জানার কোনো ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই। অথচ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের তথ্য জানার অধিকার রয়েছে। আমাদের দেশের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বিনিয়োগকারীর কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে। অথচ ইনভেস্টর রিলেশন বলে একটি বিষয় বিশ্বজুড়ে খুব সমাদৃত। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে সংস্কারের জন্য বাজেটে কিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করা হবে বলে আশা করছি।
স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ ব্যবস্থা চাই
অধ্যাপক মো. শহিদুর রহমান (অবসরপ্রাপ্ত), ইংরেজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনসায়াহ্নে এসে পেনশনভোগীদের জীবন অনেকটা চিকিৎসকনির্ভর হয়ে যায়। দেখা যায়, এই শ্রেণির মানুষদের খাবারের চেয়ে স্বাস্থ্য খাতেই বেশি ব্যয় হয়। সরকার পেনশনভোগীদের স্বাস্থ্য ভাতা কিছুটা বাড়িয়েছে সত্য, কিন্তু তা খুবই অপ্রতুল। বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতালে সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে ওঠে। সরকার পেনশনভোগীদের বিশেষ মেডিকেল কার্ড দিতে পারে, যা দিয়ে হাসপাতালে ছাড় পাওয়া যাবে।
পেনশনভোগীদের বিনিয়োগের বিশেষ ক্ষেত্র নেই। সঞ্চয়পত্রই তাঁদের একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেই সঞ্চয়পত্র থেকেও সরকার উৎসে কর নিচ্ছে। তারপর এবার তা বাড়ানো হবে শুনছি। সেটা হলে পেনশনভোগীদের হাত-পা বেঁধে দেওয়ার শামিল হবে। পেনশনভোগীদের আয় বলতে তো সঞ্চয়পত্রের সুদ। তাই সেখান থেকে কি সরকারের উৎসে কর না কাটলেই নয়?
নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে পেনশনভোগীরা বিপাকে পড়েন। বিশেষ করে রমজান মাসে ভোগ্যপণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে পড়ে। এতে আমাদের মতো মানুষদের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। সরকার এ ব্যাপারে বিশেষ নজর দেবে, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
পেনশনভোগীদের জীবন তো আর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, তাই সমাজের আঁচ আমাদের গায়ে লাগে। ধানের দাম কমে যাওয়া নিয়ে বলতেই হয়। শহরের পেনশনভোগীরা অনেকেই গ্রামে ধান চাষে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু দাম পড়ে যাওয়ায় মুনাফা তো দূরের কথা, বিনিয়োগের টাকাই তাঁরা ফেরত পাচ্ছেন না।
এ ছাড়া পেনশনের টাকা তুলতেও অনেক ভোগান্তি পেতে হয়। সরকারের উচিত, নির্বিঘ্নে এই টাকা তোলার ব্যবস্থা করা।