>করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত অর্থনীতি। কঠিন এক সময়ে পেশ করা হলো ২০২০-২১ অর্থবছরের নতুন বাজেট। অর্থমন্ত্রী আশ্বাস দিলেন জীবিকা বাঁচানোর। এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা ও বিশ্লেষণ। বাজেটে তরুণদের চাওয়া নিয়ে এই আয়োজন।
করোনা পরিস্থিতিতে টালমাটাল অর্থনীতি সামাল দিতে ঠিক কোন ধরনের বাজেট কার্যকর হবে, সে সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেই কারও। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের এই বাজেটে করোনাকালে স্বাস্থ্য বা শিক্ষা খাতে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটবে, এমনটাই আশা করেছিলাম। তবে এই মুহূর্তে মানুষকে সুরক্ষা দিতে স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজানোর জন্য যে বাজেটের প্রয়োজন ছিল, সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
মার্চের মাঝামাঝি থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর সাধারণ শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন কার্যক্রম শুরু করলেও থমকে আছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাদান। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে প্রযুক্তি বাদ দিলে শুধু শিক্ষার জন্য রাখা হয়েছে কেবল ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এদিকে, প্রান্তিক এলাকায় থাকা শিক্ষার্থীদের বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনের নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারিনি।
এই বাজেটে জরুরি অবস্থায় শিক্ষার চাহিদা পূরণ করতে শিক্ষকদের কীভাবে প্রস্তুত করা হবে কিংবা করোনা শেষের ‘নিউ নরমালের’ সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যাবে, সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। বাজেট দেখে মনে হয়েছে, করোনা যেমন হঠাৎ করে এসেছে, তেমনি হঠাৎ করেই চলে যাবে, এমনটা ধরে নিয়ে আগানো হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি ঠিক হতে আরও প্রায় দুই-তিন বছরও সময় লাগতে পারে। তত দিন নিশ্চয়ই শিক্ষাব্যবস্থা থেমে থাকবে না। সেশনজট নামক বিভীষিকা এড়িয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই গ্যাপ কীভাবে পূরণ করা যায়, তা চিন্তার বিষয়।
প্রস্তাবিত বাজেটের একটি ইতিবাচক দিক দেশি পণ্যের দাম কমানো। অন্যদিকে বাড়ছে বিদেশি পণ্যের দাম। আমদানি করা পেঁয়াজ, লবণ, মধু, দুধ, দুগ্ধজাতীয় পণ্যের শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে দেশীয় পণ্যের খাতে বিনিয়োগ বাড়বে, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। তবে মুঠোফোন, ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর কর বাড়ানোর সিদ্ধান্তে সাধারণ জনগণের ভোগান্তি বাড়বে।
করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রান্তিক চাষি, ভূমিহীন কৃষক বা স্বল্প মূলধনের কৃষি উদ্যোক্তারা। দেশের এক ইঞ্চি জমিও খালি রাখা হবে না বলা হলেও বাজেটে এই কৃষকদের জন্য আলাদা কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতের প্রধান উপকরণসমূহ বিশেষ করে সার, বীজ, কীটনাশক আমদানিতে শূন্য শুল্ক হার অব্যাহত রাখা হয়েছে। ধান রোপণ, কাটা ও মাড়াইয়ের যন্ত্র কিনতে ঋণসহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে লাভবান হবে মাঝারি বা তার উচ্চপর্যায়ের চাষিরা। প্রান্তিক চাষিরা ঋণ সুবিধার সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হবেন, তার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করতে না পারলে প্রকৃত অভাবগ্রস্তরা সুবিধাবঞ্চিত হবেন।
প্রস্তাবিত গতানুগতিক বাজেটে রয়েছে আয়-ব্যয়ের বিশাল ঘাটতি। তবে দুর্নীতি বন্ধ করে সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মেলবন্ধনে সুপরিকল্পিতভাবে অর্থ বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করা সম্ভব বলেই আমার বিশ্বাস।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির করপোরেট করহার এবারের বাজেটে আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। আমি মনে করি এটি খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। অনেক দিন ধরেই করপোরেট কর কমানোর দাবি করে আসছিলেন ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা। এবার সেখানে কিছুটা হলেও সরকার নজর দিয়েছে।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বিদেশি অনেক বিনিয়োগকারী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা খতিয়ে দেখছেন। আমি মনে করি, করপোরেট কর কমানোর এ সিদ্ধান্ত বিনিয়োগ আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে এখানে একটি কথা বলা দরকার। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে আমাদের দেশের করপোরেট করহার আরও কমিয়ে আনা দরকার।
আবার অন্যদিক তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির করহার কমানোর ফলে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে কর ব্যবধান কমে গেছে। এতে করে কোম্পানিগুলোর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির আগ্রহ কমে যেতে পারে। তাই মনে করি, তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির করহারের ব্যবধান কমপক্ষে ১০ শতাংশ রাখা উচিত। বাজেট পাস হওয়ার আগে তাই তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারও সমানভাবে কমানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
আমরা দেখছি, করোনার কারণে দেশে বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকসহ বেসরকারি খাতে কর্মী ছাঁটাই ও বেতন কমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ প্রবণতা বন্ধে সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার। এমনিতেই আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেশি। সেটি আরও বেড়ে গেলে অর্থনীতিতে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাই বিদ্যমান কর্মসংস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান বাড়াতে সরকারের দিক থেকে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকা উচিত।
আমরা সব সময় দেখি, বিদ্যমান করদাতাদের ওপর করের চাপ বাড়িয়ে সরকার রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। অথচ নতুন করদাতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে খুব বেশি উদ্যোগ দেখা যায় না। বিদ্যমান করদাতাদের ওপর করের চাপ বাড়ানো হলে তাতে কর ফাঁকির প্রবণতাও বাড়বে। আগামী অর্থবছর সরকার নতুন করদাতা খুঁজে বের করতে বিশেষ উদ্যোগ নেবে বলে আশা করছি।
করোনা ও কর্মসংস্থান—এ দুটি নিয়েই এখন দেশের অধিকাংশ মানুষ সবচেয়ে বেশি আতঙ্কগ্রস্ত। একদিকে করোনার ভয়, অন্যদিকে চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তা। তরুণ চাকরিজীবী ও তাঁদের পরিবারের মধ্যে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু বাজেটে নীতি সহায়তার মাধ্যমে মানুষের এ দুশ্চিন্তা লাঘবে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো ঘোষণা দেখতে পাইনি।
করোনার এ সময়ে দরকার মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা। চিকিৎসা পাওয়া এ দেশে যেকোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার। নাগরিকের সেই অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। সে জন্য বেসরকারি সব হাসপাতালকে এ চিকিৎসা কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ যাতে বিনা খরচে ওই সব হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারে, তার জন্য বাজেটে সরকার আলাদা অর্থ বরাদ্দ রাখবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু তার প্রতিফলন দেখতে পাইনি।
এ ছাড়া চিকিৎসা গবেষণায় সরকারের অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। হাসপাতালগুলোতে অতিদ্রুত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ, ভেন্টিলেটর সুবিধা বাড়াতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এবারের বাজেটে সরকার ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়েছে। কমিয়েছে করহারও। এতে আমার মতো সাধারণ করদাতারা কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন। আবার করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হলেও নিত্যদিনের জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় অনেক সেবা ও পণ্যের ওপর শুল্ক, ভ্যাট, সেবা মাশুল বাড়ানো হয়েছে। তাতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর যে সুবিধা সাধারণ মানুষের পাওয়ার কথা, শেষ পর্যন্ত তা হয়তো মিলবে না। নানাভাবে খরচের চাপে থাকবে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ। মোবাইল ফোনের সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি সাধারণ মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছি, ব্যাংকসহ বেসরকারি খাতে কর্মী ছাঁটাই ও বেতন কমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একেকজন চাকরিজীবীর সঙ্গে একেকটি পরিবার যুক্ত। এখন ছাঁটাই কিংবা বেতন কমানো হলে তাতে চাকরিজীবী পরিবারগুলো হঠাৎ করে বড় ধরনের বিপদে পড়বে। আমি মনে করি, যেসব প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই ও বেতন কমাবে না, সরকার তাদের করছাড়ের বিশেষ সুবিধা দিক।
একজন ব্যাংকার হিসেবে আমি দেখছি, মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা ও সক্ষমতা দুটোই কমে গেছে। অনেকে সঞ্চয় ভাঙিয়ে চলছেন। সঞ্চয় বা আমানত কমে গেলে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও কমে যাবে। সেটি দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেই সুখকর হবে না।
এবারের বাজেটে ব্যাংকে ১০ লাখ টাকার বেশি থাকলে তার ওপর শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। আবার সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রেও কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমার বাবা-মা দুজনই অবসরভোগী, গ্রামে থাকেন। তাঁদের পক্ষে টিআইএন করা ও বছর বছর রিটার্ন দেওয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ। ব্যাংকে টাকা রাখলে সুদ কম, আবার সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে টিআইএন ও রিটার্নের ঝক্কি। তাহলে দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ ও অবসরভোগীরা কোথায় যাবেন? আমি মনে করি, সরকার তাঁদের বিষয়টি ভাববে। অবসরভোগীদের আয়ের পথটি মসৃণ রাখবে।
২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট অত্যন্ত অভিলাষী বলে আমার ব্যক্তিগত মতামত। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ এবং তা পূরণের খাত দুটোতে মিল করা অত্যন্ত কঠিন হবে মনে হয়। প্রতিবারের মতো রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ মূলত আসবে ব্যক্তিগত আয়কর থেকে। অবশ্য ব্যক্তিশ্রেণির আয়করের সীমা বাড়ানো হয়েছে। তারপরও সরকার যেহেতু আরেকটি বড় পদক্ষেপ নিচ্ছে জেনে থাকবেন, এক মালিকানাধীন কোম্পানির নিবন্ধিত যা করের নির্ভরযোগ্য একটি উৎস হতে পারে। এ ছাড়া ডিজিটাল খাতে, যেমন ফেসবুক বা ইউটিউবের বিজ্ঞাপন করের আওতাভুক্ত হচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
কিছু উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। যেমন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা দুই হাজার কোটি টাকার যে ঋণের সুবিধা পাচ্ছেন, এখন এই সুবিধা যাতে আসল উদ্যোক্তারা পেতে পারেন, তার সার্বিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ করোনা। সার্বিক অর্থনীতি করোনার পর একটা দীর্ঘ সময়ে মন্দার কবলে পড়তে যাচ্ছে, কাজেই বাজেটে প্রচুর পরিমাণে ছোট ও মাঝারি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণ জনগণ করোনা–পরবর্তীকালে দুর্বল অর্থনীতির শিকার হয়ে প্রচুর দুর্ভোগের শিকার হতে পারে, তখন এই উদ্যোক্তা বলয়ে যাতে অর্থনীতির চাকা সচল থাকে, সেটা মাথায় রাখতে হবে।
বিশ্বব্যাপী মহামারির পর সব দেশ এটি অনুধাবন করেছে যে স্বাস্থ্য খাত সর্বকালের উপেক্ষিত একটি খাত। আমার মতে, সব বাজেটেই স্বাস্থ্য-চিকিৎসা এবং কর্ম খাতে সর্বোচ্চ সরকারি বিনিয়োগ থাকা দরকার। এবার করোনা মোকাবিলায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা যথেষ্ট হয়নি বলে মনে করছি। অবশ্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা সুষ্ঠু ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন করোনা মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে তা কীভাবে ব্যয় হবে, বলা হয়নি। আমার মনে হয়, এটি সুষ্ঠুভাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
সরকারের এবারের নতুন বহুল সমালোচিত একটি পদক্ষেপ হলো টেলিকম খাতের সম্পূরক কর বৃদ্ধি। এতে বরাবরের মতো এবারও সাধারণ জনগণ উপেক্ষিত হবে। কারণ, সাধারণ প্রান্তিক ব্যবহারকারীকেই এই করের বোঝা টানতে হচ্ছে বা হবে। সরকারের উচিত টেলিকম খাতে অসম প্রতিযোগিতা বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা। সফল বাজেট আসলে অনেকটা মিথের মতো, সব দিক সাফল্যের কথা বিবেচনা করে বাজেট করা বেশ কঠিন। তবে সর্বোপরি নির্দেশনা অনুযায়ী পালন করলে আশা করা যায় অন্তত ঘাটতির পরিমাণ কমে আসবে।
এবারের বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। যদিও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে তুলনা করলে এ বরাদ্দ খুব একটা বাড়েনি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, করোনা মহামারির কারণে অনেক শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে, যার বেশির ভাগই সমাজের নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তান। করোনা এসব পরিবারের আয়রোজগারও বলতে গেলে বন্ধ করে দিয়েছে। তাই ভবিষ্যতে শিক্ষা খাতে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। নিম্ন আয়ের মানুষেরা ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর বদলে বিভিন্ন ধরনের কাজে যুক্ত করে তাদের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করবে। এতে দেখা যাবে দেশে রাতারাতি শিশুশ্রম বাড়বে, আবার বাল্যবিবাহের হারও বেড়ে যাবে। তাই আমার প্রত্যাশা ছিল এ করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখবে। কিন্তু সেটি হয়নি।
অন্যদিকে করোনা আমাদের স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর দশাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা দেখলাম এ খাতে অর্থের চেয়ে বড় সংকট ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির। বাজেটে যেটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয় তার সিংহভাগ দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে অপচয় হয়। ফলে কিছু ভবন নির্মাণ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের প্রকৃত উন্নতি খুব বেশি হয়নি। তাই আমি মনে করি, বাজেট বরাদ্দের চেয়ে এ খাতের জন্য অধিক জরুরি অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি দূর করা। জরুরি অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি দূর করা।
২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট দেখে মনে হয়েছে, এ বাজেট যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তবে তা হবে সময়োপযোগী, সুচিন্তিত, বিনিয়োগবান্ধব। পাশাপাশি করোনার বিরূপ প্রভাব কাটাতে কার্যকরী এবং এককথায় উন্নয়ন ও গণমুখী বাজেট। তবে জাতীয় অর্থনীতিতে বাজেট প্রস্তাবের প্রভাবের চেয়ে অর্থবছরজুড়ে প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন করাই সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং।
মূলত বৃহৎ জনবেষ্টিত রাষ্ট্রের বড় আকারের বাজেট সম্পূর্ণরূপে দেশের সব খাতের জন্য পছন্দসই হবে, তা হতে পারে না। তবে বাজেট নির্ধারণে সময়ের প্রয়োজনে তা উপযোগী এবং চলমান অর্থবছরে যেসব খাতের প্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা প্রয়োজন, তার ইঙ্গিত প্রস্তাবিত বাজেটে দেখা গেছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে কিন্তু এ বরাদ্দকৃত অর্থ দ্বারা যাতে উন্নয়ন ও সেবামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয় সে ব্যাপারে বিশেষ নজর রাখতে হবে। কারণ, করোনাকালীন এবং পরবর্তী অর্থনীতিতে এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। করোনা প্রভাবিত ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনর্জীবনের ভিত্তি প্রস্তুত করার যথেষ্ট সুযোগ এ বাজেটে রয়েছে। প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ বাজেটে বেঁচে থাকার আবশ্যক দ্রব্যাদির এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট দ্রব্যাদির মূল্যহ্রাসের ইঙ্গিত রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণের আমদানি, উৎস কর, কৃষি খাতে কর নমনীয়তা, চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিতে ব্যয় কমানো, রপ্তানি করা পোশাকশিল্পের নগদ সহায়তা চলমান রাখা, ব্যক্তিশ্রেণিতে করের ছাড় এবং করপোরেট কর কমানোসহ নানা দিকে দেখে মনে হয়েছে, প্রস্তাবিত বাজেট অনেকাংশেই কঠিন সময়ের আশাব্যঞ্জক বাজেট।
করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো এবং সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করার কারণে করদাতাদের ওপর কর বোঝা কিছুটা হলেও লাঘব হবে। অন্যদিকে এ বাজেটের ইতিবাচক দিক হচ্ছে, স্বাস্থ্য খাত, সামাজিক সুরক্ষা খাত, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে বেশ কিছু পদক্ষেপ রয়েছে। অন্যদিকে কোভিড-১৯ চিন্তাকে মাথায় রেখে সরকার এ বাজেটে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইন আয়কর জমাদানে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা যেমন বর্তমান করদাতাদের জন্য ভালো দিক এবং নতুন করদাতাদের জন্যও উৎসাহের ব্যাপারও বটে। এ কারণে আদায়কৃত করের পরিমাণও বাড়বে বলে বিশ্বাস করি।
সরকার শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের পরিমাণ বৃদ্ধিসহ রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতার জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদানসহ যেসব আর্থিক ও নীতিগত সহায়তা প্রদান করেছে, তা প্রশংসনীয়।
তবে বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনীতির কিছু সূচকের দিকে নজর দেওয়াও জরুরি। আবার ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, এই পরিস্থিতিতে সেটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সঞ্চয়ের ওপর যে অতিরিক্ত কর সেটা মধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়াবে। বাজেট বাস্তবায়নে কার্যকর নজর প্রদান এবং ত্রৈমাসিক ভিত্তিকে তদারকির মাধ্যমে এ বাজেটের সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করলে করোনাকালীন ভঙ্গুর অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরানো সম্ভব।
শুধু রাষ্ট্রীয় জীবনেই নয়, আমার মতো ব্যক্তিদের জীবনেও এ বাজেট-পরবর্তী প্রভাব লক্ষণীয়। এ বাজেটে অনলাইন কর প্রদানে বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা যেমন ব্যক্তিগতভাবে কর প্রদানে উৎসাহিত করছে, তেমনি সময় ও অবাঞ্ছিত শ্রম থেকে রেহাইও দিচ্ছে।
আবার মোবাইল সেবার ওপর ১৫ শতাংশ সম্পূরক কর প্রস্তাব আমাদের ব্যক্তিগত ব্যয়ভার বাড়বে বলে আমি মনে করি। অন্যদিকে বাজেট নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, কৃষিপণ্য ও চিকিৎসা খাতে ইতিবাচক হওয়ায় এর প্রভাব ব্যক্তিজীবনে অবশ্যই প্রতিফলিত হবে।