রান্না করতে যাঁরা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করেন, তাঁদের জন্য দুঃসংবাদ। নতুন বাজেটে ১২ কেজির এক সিলিন্ডার গ্যাসের ওপর বাড়তি ৫০ টাকা কর বসছে। ফলে এখন যদি ৯৫০ টাকা দিয়ে একটি সিলিন্ডার কিনতে পারেন, সামনে সেটি কিনতে হবে ১ হাজার টাকায়।
নতুন বাজেট এমন একগাদা দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে। এর প্রভাব এরই মধ্যে বাজারে কিছু পড়তে শুরু করেছে।
নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেন। এতে ঘোষণা করা সম্পূরক শুল্ক, আমদানি পর্যায়ে সব কর, শুল্ক ও ভ্যাট সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হয়ে গেছে। স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাটের নতুন হার কার্যকর হবে আগামী মাস, অর্থাৎ জুলাই থেকে। যদিও অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমরা ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটটিতে দেশের জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারে, তেমন কোনো উপকরণ অন্তর্ভুক্ত করি নাই।’
নতুন বাজেটের কারণে এলপিজি ছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে খরচ বাড়তে পারে, তা একনজরে দেখে নেওয়া যাক। বাজেট ঘোষণার পর বাজারে চিনির দাম প্রায় ৩ টাকা ও ভোজ্যতেলের দাম প্রায় আড়াই টাকা বেড়েছে। বাড়বে শিশুখাদ্যের দামও। গুঁড়া মসলা, ভালো মানের বিস্কুট, কেক, ফলের রস, আচার ও আইসক্রিম থাকতে পারে মূল্যবৃদ্ধির তালিকায়। খাবার খাওয়ার জন্য তৈজসপত্র কিনতে বাড়তি টাকা লাগবে। পোশাকেও আগের চেয়ে বেশি হারে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) দিতে হবে। যাতায়াতেও আগের চেয়ে কিছুটা খরচ বাড়তে পারে।
এসব ব্যয়ের কথা স্বজনকে জানাবেন, সেখানেও বাড়তি কর চেপেছে। মুঠোফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক আরও ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার, যা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করেছে অপারেটরেরা। ফলে এখন থেকে মুঠোফোনে কথা বলার ওপর কর দাঁড়াল মোট ২৭ শতাংশ। এর মানে হলো, আপনি যদি ১০০ টাকা রিচার্জ করেন, তাহলে ২২ টাকার মতো যাবে সরকারের কোষাগারে। যাঁরা ফিচার ফোন থেকে স্মার্টফোনে উন্নীত হয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে চান, তাঁদের স্মার্টফোন কেনার খরচ অনেক বেশি বাড়বে।
এসব গেল কর-ভ্যাটের কারণে প্রত্যক্ষভাবে বাড়তি ব্যয়ের হিসাব। আরও কয়েকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে শুরুতেই আসবে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম। এ খাতে যে বিপুল ভর্তুকি লাগবে, তা বাজেটে রাখা হয়নি। অবশ্য দাম বাড়ানোর বিষয়ে বাজেটের আগেই এ বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সূত্রের খবর, আগামী মাসেই মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা আসতে পারে।
দ্বিতীয় আরেকটি উপায়ে চাপ আসতে পারে। সেটি হলো, ঢাকার পাইকারি ও বড় খুচরা বিক্রেতারা আগে বছরে ২৮ হাজার টাকা প্যাকেজ ভ্যাট দিয়ে মুক্তি পেতেন। তাঁরা গ্রাহকের কাছ থেকে আলাদাভাবে ভ্যাট আদায় করতেন না। এখন তাঁদের ৪ শতাংশ লেনদেন কর দিতে হবে। যেসব দোকানে দৈনিক ২০ হাজার টাকা বিক্রি, তার লেনদেন কর আসে মাসে ২৪ হাজার টাকা। এ টাকাটা আর তিনি পকেট থেকে না দিয়ে গ্রাহকের ওপর চাপাবেন। এতে পণ্য ও সেবার দাম বাড়তে পারে।
সাজ্জাদ হোসেন চাকরি করেন, কারওয়ান বাজার থেকে কেনাকাটা করছিলেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ধরেন চিনির দাম ৫ টাকা বাড়ল। এতে মাসে আমার খরচ বাড়বে ১৫ টাকা। হিসাব করতে গেলে মনে হবে এটা খুব বেশি নয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, চিনির পেছনে সংসারে যে বরাদ্দ তাতে ১৫ টাকা বাড়লে চাপ কিন্তু কম পড়ে না।’ তিনি বলেন, এভাবে এক টাকা, দুই টাকা করেই সংসারের ব্যয় অনেক বেড়ে যায়।
মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় অনেক পণ্য থাকলেও কমার তালিকায় উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। গরিবের রুটি-বিস্কুট, কৃষিযন্ত্র, বজ্রপাত সুরক্ষাসামগ্রী, ক্যানসারের ওষুধ ও গাড়ির ব্রেকের দামে ইতিবাচক কিছু প্রভাব ফেলতে পারে এবারের বাজেট।
খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে
এবারের বাজেটে নতুন করে চিনির যে করহার বাড়ানো হয়েছে, তাতে চিনির দাম বাড়বে ৫ টাকা। এতে চিনির ওপর মোট করভার দাঁড়াচ্ছে ২১ টাকা (এখনকার মূল্যে)। নতুন বাজেটের কারণে সয়াবিন তেলের ওপরও ৩ টাকার মতো বাড়তি কর দাঁড়াবে। পাইকারি বাজারের পর বড় খুচরা বাজারে চিনির দাম বাড়তে শুরু করেছে। কারওয়ান বাজারে গতকাল মঙ্গলবার প্রতি কেজি চিনি ৫৪-৫৫ টাকা চান বিক্রেতারা, যা আগে ৫২-৫৩ টাকা ছিল। একইভাবে খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে কেজিপ্রতি ৮০ টাকায় উঠেছে, যা আগের চেয়ে ২ টাকা বেশি।
বাজেটে গুঁড়া দুধ আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে বিদেশ থেকে আমদানি করা গুঁড়া দুধের দাম বাড়তে পারে। আইসক্রিমের ওপর ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। অলিভ অয়েলের দাম বাড়বে শুল্ক হারের কারণে।
গুঁড়া মসলা, বিস্কুট, কেক, ফলের রস, আচার ইত্যাদির ক্ষেত্রে ভ্যাটের বোঝা বাড়বে। যেমন মরিচ, ধনিয়া ও হলুদের গুঁড়ার দাম আগে কেজিপ্রতি ৪০ টাকা ধরে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসত। এতে গুঁড়া মসলার ওপর ভ্যাট দাঁড়াত কেজিতে ৬ টাকা। এখন এর প্রকৃত মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসবে। এতে ৩০০ টাকা কেজি হলে ভ্যাট আসবে ১৫ টাকা। এভাবে একটু বেশি দামি বিস্কুট, কেক, ফলের রস, সরিষার তেল, সস ইত্যাদির ওপর ভ্যাটের চাপ বাড়তে পারে।
>কর বাড়ানোসহ বিভিন্ন কারণে কিছু পণ্য-সেবার দাম বাড়বে
তেল, চিনি, গুঁড়া দুধ, গুঁড়া মসলায় বাড়তি কর
কথা বলা, স্মার্টফোন কেনা, পোশাক কেনায় খরচ বাড়বে
তৈজসপত্র কিনতেও এখন বাড়তি টাকা খরচ হতে পারে
গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সামনেই
পরোক্ষ কিছু কারণে চাপ বাড়বে জীবনযাত্রায়
নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও বাড়বে
কিছু কিছু নিত্যব্যবহার্য পণ্যের ওপর কর বাড়ানো হয়েছে। এতে এগুলোর দাম বাড়তে পারে। যেমন শরীরের দুর্গন্ধ দূর করতে খরচ বাড়বে। ব্যক্তিগত ডিওডরেন্টের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। বোতল, ফ্লাস্ক, জার, পট ইত্যাদির ওপর নতুন করে ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি তৈজসপত্রের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে।
রান্নার ব্যয়ও বাড়বে
ওভেন, কুকার, কুকিং প্লেট, গ্রিলার, রোস্টার ইত্যাদির ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ আরোপ করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। রান্নার তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের দামও বাড়বে। আগে এতে ভ্যাটের ভার ছিল ৯ টাকা। এখন মোট ৫০ টাকার মতো বাড়তি কর ভার দাঁড়াচ্ছে। কারণ, এলপি ১২ কেজির সিলিন্ডারের গ্যাসের দাম ৬০ টাকা ধরে আগে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হতো। এখন প্রকৃত মূল্য, অর্থাৎ ৯০০ টাকার ওপর ভ্যাট হবে ৫ শতাংশ। এ ছাড়া সরবরাহ ও খুচরা বিক্রেতা পর্যায়েও লেনদেনে কর বসবে।
এ হিসাব দিয়ে বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) জাকারিয়া জালাল বলেন, বাড়তি ভ্যাটের কারণে মানুষের ব্যয় বাড়বে। এলপি গ্যাসে বাড়তি ভ্যাট ২০২১ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি দেওয়ার লক্ষ্যের পরিপন্থী।
এত সব ব্যয় সামাল দিতে এবার ধূমপান ছেড়ে দিতে পারেন। ইতিমধ্যে প্রতিটি সিগারেটের দাম ১ টাকা বেড়েছে। দিনে ৫টি সিগারেট কিনলে মাসে কিন্তু ১৫০ টাকা ব্যয় বাড়বে। তাই স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ধূমপান ছেড়ে দিন।
এবারের বাজেটে কর কাঠামোর কারণে মানুষের ওপর চাপ পড়ার আশঙ্কা আছে বলে মনে করেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ‘আমরা চাইছিলাম এর উল্টো। আমদানি শুল্ক ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা যেত। সীমিত আয়ের মানুষকে আয়করেও কিছু ছাড় দেওয়া যেত।’ তিনি বলেন, এনবিআরকে সরকার যখন বাড়তি রাজস্বের লক্ষ্য দেয়, তখন কোনো ধরনের প্রভাব সমীক্ষা ছাড়া কর আরোপ করতে দেখা যায়। এটা হওয়া উচিত নয়।