এক দশক আগেও সূর্যমুখী তেলের বোতল দেখা যেত সুপারশপ আর অভিজাত দোকানের তাকে। শহরের অভিজাত শ্রেণি ছিল এই তেলের মূল গ্রাহক। এখন শহরে বাড়ির পাশের দোকানের তাকেও ঠাঁই পাচ্ছে এই তেল।
স্বাস্থ্যসচেতনতার কারণে অভিজাত শ্রেণির পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও নিয়মিত বা মাঝেমধ্যে রান্নার তালিকায় রাখছেন এই তেল। প্রচলিত তেলের চেয়ে হৃদ্রোগে ঝুঁকি কমায়—পুষ্টিবিদদের এমন পরামর্শেও রান্নার তেল হিসেবে তা জায়গা করে নিচ্ছে। নতুন নতুন গ্রাহক যুক্ত হয়ে বেড়ে যাচ্ছে এই তেলের চাহিদা।
ভোজ্যতেলের বাজারে সূর্যমুখী তেলের অংশীদারি খুবই সামান্য। সয়াবিনের চেয়ে দাম দ্বিগুণের কম-বেশি হলেও এই তেলের চাহিদা বাড়ছে সবচেয়ে বেশি হারে। গত পাঁচ বছরের আমদানির তথ্য অনুযায়ী, বছরে গড়ে ৩৭ শতাংশ হারে বাড়ছে সূর্যমুখী তেল আমদানি। যেখানে একই সময়ে সয়াবিন ও পামতেলের চাহিদা বাড়ার হার সাড়ে ৭ শতাংশের মতো। সুস্থ থাকার জন্য মানুষের খাদ্যাভ্যাসে যে পরিবর্তন ঘটছে, তারই প্রভাব পড়েছে ভোজ্যতেলের বাজারেও।
সূর্যমুখী তেল সরাসরি শোধিত আকারে ও বোতলজাত করে আমদানি হয়। বাজারের এই তেলের সম্ভাবনা দেখে এই খাতে বিনিয়োগ করেছে ওষুধ কোম্পানি গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব এডিবল অয়েল। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৪৫০ কোটি টাকায় সূর্যমুখী তেলের বীজ থেকে তেল ও প্রাণিখাদ্য তৈরির কারখানা স্থাপন করেছে কোম্পানিটি। উৎপাদন শুরু হয়েছে গত বছর। প্রথম দফায় তারা ২৮ হাজার টন সূর্যমুখী তেলবীজ আমদানি করেছে, যেখান থেকে পাওয়া যাবে প্রায় ৪৪ শতাংশ তেল। এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে তারা বাজারজাত শুরু করেছে। এ ছাড়া নিজস্ব তত্ত্বাবধানে দেশে হওয়া সূর্যমুখী বীজ থেকে উৎপাদিত স্বাদ নামের সূর্যমুখী তেলও বাজারজাত শুরু হয়েছে।
জানতে চাইলে গ্লোব এডিবল অয়েলের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মো. আবু জাফর প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিমাণে কম হলেও সূর্যমুখী তেলের চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। এই চাহিদা পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। আমদানিনির্ভরতা কমাতেই কারখানা চালু করেছি আমরা। রয়েল শেফ নামে সহনীয় দামে বাজারজাতও শুরু হয়েছে।’
দেশে নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জায়গায় সূর্যমুখী চাষ হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, বছরে এখন তিন হাজার থেকে চার হাজার টন সূর্যমুখী তেলবীজ উৎপন্ন হয়। উৎপাদন বাড়লে তেলবীজও আমদানি করতে হবে না। তাতে দেশীয় কারখানার হাতে যাবে বাজারের বড় অংশ।
এ মুহূর্তে রয়েল শেফ ব্র্যান্ডের বাজারের অংশীদারি কম। সরাসরি আমদানি তেলই বাজার দখল করে আছে। বাজারে এখন হরেক ব্র্যান্ডের সূর্যমুখী তেল পাওয়া যায়। এতে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে ওলিটালিয়া। ইতালি থেকে আমদানি করা এই তেল বাজারজাত করছে ফেয়ার গ্রুপ। বোতলজাত সয়াবিনে শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ এডিবল অয়েল মালয়েশিয়ার কিংস ব্র্যান্ডের সূর্যমুখী তেল আছে দ্বিতীয় অবস্থানে। এ ছাড়া সানলিকো, অর্কিডসহ বহু ব্র্যান্ডের তেল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, বাজারে বোতলজাত সূর্যমুখী তেল আসছে আটটি দেশ থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হচ্ছে ইতালি, মালয়েশিয়া, ইউক্রেন, তুরস্ক, স্পেন, গ্রিস, সাইপ্রাস ও রাশিয়া থেকে।
ওলিটালিয়া তেল বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ফেয়ার গ্রুপের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার মো. আবদুস সালাম প্রথম আলোকে জানান, উচ্চবিত্ত, স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ ও হৃদ্রোগী—এই তিন শ্রেণির মানুষ মূলত সূর্যমুখী তেলের বড় গ্রাহক। পুষ্টিবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী সয়াবিনের পাশাপাশি অনেকেই এই তেল ব্যবহার করছেন।
বাংলাদেশে রান্নায় কম-বেশি ছয় ধরনের ভোজ্যতেল ব্যবহৃত হয়। চার দশক আগেও সরিষা ছিল প্রধান ভোজ্যতেল। নব্বই দশক থেকে পাল্টে যেতে থাকে তেলের ব্যবহার। ধীরে ধীরে প্রধান ভোজ্যতেল হিসেবে জায়গা করে নেয় সয়াবিন ও পামতেল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বা ৫২ শতাংশ চলে পামতেল। বাজারে ৩৮ শতাংশ অংশীদারি নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সয়াবিন তেল। সরিষার তেল ও ধানের কুঁড়ার তেল মিলে ৯ শতাংশ বাজার দখল করে নিয়েছে। পঞ্চম অবস্থানে আছে সূর্যমুখী তেল। এই তেলের অংশীদারি দশমিক ২ শতাংশ।
গত অর্থবছর বন্দর দিয়ে সূর্যমুখী তেল আমদানি হয় ৫৪ লাখ কেজি বা ৫৯ লাখ লিটার। পাঁচ বছর আগে আমদানি হয় প্রায় ১৯ লাখ কেজি বা ২১ লাখ লিটার। এ হিসাবে প্রায় ৪৬ কোটি থেকে বাজার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩০ কোটিতে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য, গত মৌসুমে বিশ্বে ২০ কোটি টন ভোজ্যতেল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে সূর্যমুখী তেলের পরিমাণ ১ কোটি ৯৭ লাখ টন। এর অর্ধেকের বেশি উৎপাদিত হয় ইউক্রেন ও রাশিয়ায়।