বাংলাদেশ এবারের রমজান মাস উপলক্ষে ১১২ কোটি মার্কিন ডলারের বিভিন্ন পণ্য আমদানি করেছে, যা সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার সমান। এসব পণ্য এসেছে বিশ্বের ২৮টি দেশ থেকে। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের মতো উত্তেজনা না থাকলেও বাংলাদেশের বাজার ধরতে এসব দেশের মধ্যে ছিল তীব্র প্রতিযোগিতা।
রোজার পণ্য খালাস শেষ হওয়ার পর দেখা গেছে, বাংলাদেশের বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান দখলে গেছে ব্রাজিলের। দ্বিতীয় ইন্দোনেশিয়া। তালিকায় পরের অবস্থানে রয়েছে আর্জেন্টিনা, ভারত, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো। রোজার প্রধান পণ্য ছোলা, মটর ও মসুর ডাল, সয়াবিন ও পাম তেল, চিনি ও খেজুরের আমদানি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশগুলোর এই অবস্থান পাওয়া গেছে। বছরের প্রথম চার মাসে এই সাতটি পণ্যই মোট ১১২ কোটি ডলার ব্যয়ে আমদানি করা হয়েছে।
একসময় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা রোজার পণ্য আমদানির জন্য নানা মাধ্যম খুঁজতেন। মধ্যস্থতাকারীদের সহায়তা নিতেন। তবে বাজারের আকার বৃদ্ধির পর এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরবরাহকারীরা বাংলাদেশেই কার্যালয় খুলেছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা খাতুনগঞ্জের অলিগলিতে বড় আমদানিকারকের কার্যালয়ে গিয়ে নিজ দেশের পণ্যের খোঁজ নিচ্ছেন। ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।
শীর্ষ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশের সরবরাহকারীরা স্বাভাবিকভাবেই নিজ দেশের পণ্য বিক্রির জন্য তৎপরতা চালান। তবে আমরা যেটা দেখি, সেটা হলো পণ্যের মান, মূল্য এবং সময়মতো পণ্য হাতে পাওয়া যাবে কি না—এসব বিষয়।’
রোজার পণ্যের মধ্যে অন্যতম ছোলা, যা আসছে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কিলোমিটার সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে। বন্দরের হিসাবে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত যত ছোলা আমদানি হয়েছে, তার ৭২ শতাংশ অস্ট্রেলিয়ার। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ১৩ শতাংশ বাজার নিজেদের করে নিয়েছে। কানাডার হিস্যা ৮ শতাংশ। তানজানিয়া ও পাশের দেশ ভারতও সামান্য কিছু ছোলা রপ্তানি করেছে বাংলাদেশে। একসময় ইথিওপিয়া এই তালিকায় থাকলেও এবার নেই।
আলোচ্য সময় ছোলা আমদানি হয়েছে ৯ কোটি ১২ লাখ ডলারের, যা ৭৮০ কোটি টাকার সমান।
খেজুরে আরব আমিরাত
খেজুরের বাজার ছোট, কিন্তু লড়াইটা বেশি। মোট ১১টি দেশ এবার বাংলাদেশে খেজুর রপ্তানি করেছে। এই তালিকায় ঘুরেফিরে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। তবে সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তথ্য বলছে, এ বছর চার মাসে মোট আমদানির ৬২ শতাংশই এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। অবশ্য নানা জটিলতায় আমদানির উৎস হিসেবে ইরানের নাম নেই। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আরব আমিরাত হয়ে বাংলাদেশে বাজারে ঢুকছে ইরানের খেজুর। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে ইরাকের অবস্থা ভালো না হলেও ঠিকই বাজারের হিস্যা আদায় করে নিচ্ছে তারা। বাংলাদেশের খেজুরের বাজারের ২৮ শতাংশ তাদের হাতে। এরপরই আছে আলজেরিয়া। তালিকায় আছে সৌদি আরব, তিউনিসিয়া, মিসর, কাতার, ওমান—এসব দেশও। নথিপত্রে এ বছর চার মাসে ১১টি দেশ খেজুরের ব্যবসা করেছে ২ কোটি ডলার বা ১৮৩ কোটি টাকা। বিভিন্ন সূত্র বলছে, বাস্তবে খেজুর আমদানির পরিমাণ ৮ থেকে ১০ কোটি ডলারের (৭০০ থেকে সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা) কম হবে না। বাকি টাকা অবৈধ পথে পাঠানো হয়।
ভারত থেকেও আসছে চিনি
রোজায় চিনির বাজার বেশ বড়। বড় হলেও লড়াইটা দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শীর্ষে আছে ব্রাজিল। দেশটির দখলে বাজারের ৬৮ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতের দখলে ৩২ শতাংশ। দেশের চিনির বাজার যেমন পাঁচ প্রতিষ্ঠানের হাতে তেমনি বিদেশিদের মধ্যে এই দুই দেশের হাতে। একসময় এই বাজারে অংশীদারি ছিল থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমারের মতো দেশ। তবে পরিশোধিত চিনি আমদানি কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাজারও চলে গেছে ব্রাজিলের হাতে।
>ছোলা আমদানির ৭২ শতাংশ অস্ট্রেলিয়ার
খেজুর বেশি এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে
চিনিতে আমদানি বেশি ব্রাজিল থেকে, ৬৮%
সয়াবিনে আর্জেন্টিনা, ৮৫%
পাম তেলে ইন্দোনেশিয়া ৯৪%
চিনির চেয়ে কিছুটা প্রতিযোগিতা বেশি আছে ভোজ্যতেলের বাজারে। সয়াবিন তেল উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে থাকা আর্জেন্টিনার দখলে বাংলাদেশের বাজারের ৮৫ শতাংশ। ব্রাজিলের হাতে আছে ১৫ শতাংশ। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মধ্যখানে অবস্থিত প্যারাগুয়ের অংশীদারি দেশটির আয়তনেরই মতোই ছোট। ১ শতাংশেরও কম। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র এই বাণিজ্য লড়াইয়ে সামনের কাতারে ছিল। ২০১৪ সালের পর আর ঠাঁই হয়নি দেশটির।
পাম তেলে এখন ইন্দোনেশিয়া
বাংলাদেশের পাম তেলের বাজার এখন ইন্দোনেশিয়ার দখলে। দুই দশক আগে মালয়েশিয়ার হাতে ছিল সিংহভাগ বাজার। এখন বাজারের ৯৪ শতাংশ ইন্দোনেশিয়ার হাতে। মালয়েশিয়ার হাতে মাত্র ৪ শতাংশ।
মটর ডালের বাজারে কানাডা শীর্ষে, ৭৫ শতাংশ তাদের দখলে। পরের অবস্থান ইউক্রেনের হাতে, ১৫ শতাংশ। ছোট্ট অংশীদারি নিয়ে এই তালিকায় আছে রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া। মলদোভার মতো দেশও আছে এই তালিকায়। মসুর ডালে আছে আটটি দেশের নাম। এর মধ্যে কানাডার হাতে ৫৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ার হাতে ৪১ শতাংশ। আর রাশিয়ার হাতে আছে ২ শতাংশ। তালিকায় থাকলেও খুবই নগণ্য তুরস্ক, কাজাখিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারি।