সমুদ্রগামী জাহাজ ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা। সমুদ্র পরিবহনে সক্ষমতা বাড়ছে, আয় বাড়ছে।
বাংলাদেশ থেকে ব্রাজিলের সমুদ্রবন্দর পোর্ট অব সান্তোসের দূরত্ব ১৫ হাজার কিলোমিটারের বেশি। গুগল ম্যাপ বলছে, ওই বন্দরে যেতে পাড়ি দিতে হয় ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর। গতকাল বুধবার এই প্রতিবেদন লেখার সময় বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি মেঘনা অ্যাডভেঞ্চার সান্তোসের পথে ছিল।
জাহাজটির মালিক বাংলাদেশি শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই), যারা ব্রাজিল থেকে অপরিশোধিত চিনি ও সয়াবিনবীজ আমদানি করে দেশে পরিশোধন করে। তাদের মোট ১৫টি সমুদ্রগামী জাহাজ রয়েছে।
শুধু এমজিআই নয়, সমুদ্রগামী জাহাজ ব্যবসায় বিনিয়োগ আছে দেশের ১২টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। তাদের জাহাজ সাগর, মহাসাগর পাড়ি দিয়ে পণ্য পরিবহন করে। বিশ্বের নানান দেশের বন্দরে ওড়ায় বাংলাদেশের পতাকা। কয়েক বছর ধরে জাহাজে বিনিয়োগ বাড়ছে।
জাহাজ ব্যবসায় বাংলাদেশিদের এই বিনিয়োগ সম্ভাবনার নতুন দরজা খুলছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে জাহাজভাড়ার পেছনে বাংলাদেশকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয়। এখন সেখান থেকে বাংলাদেশের আয়ও বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে জাহাজভাড়া বাবদ বাংলাদেশের আয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩৬ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩ হাজার ১১০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের মালিকানায় এখন সমুদ্রগামী জাহাজ রয়েছে ৮০টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো বাল্ক বা খোলা পণ্য পরিবহনের জাহাজ, ৬১টি। বাকিগুলো কনটেইনার পরিবহনকারী, জ্বালানি তেল পরিবহনকারী ট্যাংকার ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলিপিজি) পরিবহনকারী জাহাজ।
বৈশ্বিক পর্যায়ের বিবেচনায় বাংলাদেশি জাহাজগুলোর আকার মূলত মাঝারি। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় জাহাজটি হলো জ্বালানি তেল পরিবহনের জাহাজ। নাম ওমেরা লিগ্যাসি। এটি এক লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল পরিবহন করতে পারে। কনটেইনার জাহাজ রয়েছে ছয়টি। এগুলো মূলত ফিডার জাহাজ, যা চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার বন্দরে যাতায়াত করে।
বছর বছর জাহাজ নামানোর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৭ সালে দেশীয় উদ্যোক্তারা চারটি জাহাজ সমুদ্রে নামিয়েছিলেন। ২০২১ সালে নামিয়েছেন ১৮টি, যা সর্বশেষ পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড প্রতিবছর দেশভিত্তিক উপকূলে চলাচলকারী ও সমুদ্রগামী জাহাজের (এক হাজার গ্রস টনের বেশি) মালিকানার তথ্য প্রকাশ করে। তাদের হিসাবে, বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৯তম। বাংলাদেশ ৫ বছরে এ ক্ষেত্রে ১২ ধাপ এগিয়েছে। এ দেশে মালিকানায় আছে ১৮৩টি জাহাজ। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। ওপরে আছে ভারত (১৬তম)। ভারতের মালিকানায় জাহাজ আছে ১ হাজার ৭০টি। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান অনেক পেছনে, যৌথভাবে ৮৭তম।
আঙ্কটাডের এই হিসাব ২০২০ সাল পর্যন্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এতে দেখা যায়, বিশ্বে মোট বাণিজ্যিক জাহাজ রয়েছে ৫৩ হাজার ৯৭৩টি (এক হাজার গ্রস টনের বেশি)। মালিকানার দিক দিয়ে শীর্ষ পাঁচ দেশ চীন, গ্রিস, জাপান, সিঙ্গাপুর ও জার্মানি। জাহাজের মালিকানার ৫০ শতাংশই এসব দেশের হাতে।
বাংলাদেশি পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজ সেবায় পথপ্রদর্শক অ্যাটলাস শিপিং লাইনস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সানাউল্লাহ চৌধুরী। তাঁর হাত ধরে বেসরকারি খাতে ১৯৭৮ সালে ১০ হাজার টন পণ্য পরিবহনক্ষমতার ‘এমভি আল সালমা’ জাহাজ প্রথম নিবন্ধিত হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে আবুল খায়ের চৌধুরী, অ্যাকুয়াটিক শিপিংসহ অনেক প্রতিষ্ঠানই যুক্ত হয়, যাদের দেখানো পথ ধরে বেড়েছে জাহাজের বহর।
সরকারি খাত শুরুতে বিনিয়োগে শীর্ষে থাকলেও এখন নেই। ১৯৭২ সালের জুনে ‘এমভি বাংলার দূত’ জাহাজ দিয়ে শিপিং করপোরেশনের বহর বাড়ানো শুরু হয়। ১৯৯১ সালের পর ২৭ বছরে কোনো জাহাজ যুক্ত না হওয়ায় সরকারি সংস্থাটির বহর ছোট হয়ে যায়। তিন-চার বছর আগে ১ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকায় কেনা ৬টি নতুন জাহাজ সংগ্রহের পর সংস্থাটির বহর বেড়ে দাঁড়ায় ৮টিতে।
নৌ বাণিজ্য কার্যালয়ের নিবন্ধনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের এখন সমুদ্রগামী যে ৮০টি জাহাজ আছে, তার মধ্যে ২৩টি কেএসআরএমের, ১৫টি এমজিআইয়ের, ১০টি আকিজ গ্রুপের, ৮টি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের, ৬টি কর্ণফুলী লিমিটেডের, ৫টি করে বসুন্ধরা গ্রুপের ও বিএসএ গ্রুপের এবং ৩টি এমআই সিমেন্টের। এর বাইরে একটি-দুটি করে জাহাজ রয়েছে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর।
উদ্যোক্তারা বলছেন, সমুদ্রগামী জাহাজ সেবায় বড় পরিসরে বিনিয়োগ শুরু হয় মূলত ২০১৯ সাল থেকে। দুই বছরে ৩২টি জাহাজ নামিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। একেকটি জাহাজে বিনিয়োগের পরিমাণ গড়ে ১৫০ কোটি টাকা। সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতির হিসাবে, বর্তমানে এই খাতে মোট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ১৫০ কোটি ডলারের মতো (সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা)।
নৌ বাণিজ্য কার্যালয়ের নিবন্ধনের তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্রগামী জাহাজ ব্যবসায় শীর্ষে থাকা কেএসআরএম গ্রুপ গত তিন বছরে ছয়টি জাহাজ নামিয়েছে। ২০০৪ সালে ইস্পাত খাতের এই প্রতিষ্ঠান জাহাজ ব্যবসায় নামে। অবশ্য বিগত তিন বছরে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক জাহাজ নামিয়েছে এমজিআই। এ সময়ে তারা নামিয়েছে ১৪টি জাহাজ। তারা আরও ৭টি জাহাজ নামানোর পরিকল্পনা করছে। জানা গেছে, এসব জাহাজে তারা বিনিয়োগ করবে ১৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
এমজিআইয়ের চেয়ারম্যান ও সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতির সহসভাপতি মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, সরকার এই খাতে কিছু সুবিধা দেওয়ায় মেঘনা গ্রুপের মতো অনেক উদ্যোক্তা এগিয়ে এসেছেন। তবে শতভাগ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করলেও রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে এটি স্বীকৃতি পায়নি। ফলে রপ্তানিমুখী খাতের মতো নীতিসহায়তা পাচ্ছে না।
জাহাজ ব্যবসায় তৃতীয় অবস্থানে আকিজ গ্রুপ তাদের ১০টির মধ্যে ৮টি জাহাজ নামিয়েছে সর্বশেষ তিন বছরে। বসুন্ধরার চারটি জাহাজ এই তিন বছরেই নিবন্ধিত হয়।
দেশে বেসরকারি খাতে প্রথম জাহাজ নামে ১৯৭৮ সালে, নাম এমভি আল সালমা। এরপর দীর্ঘ সময় এ খাতে বড় বিনিয়োগ হয়নি। হঠাৎ করে কয়েক বছর ধরে কেন বড় গ্রুপগুলো এই ব্যবসায় নামছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। তাঁরা মোটাদাগে দুটি কারণ তুলে ধরেছেন—১. প্রয়োজন। ২. নীতিসহায়তা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে উৎপাদনমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে বড় গোষ্ঠীগুলোর জাহাজ প্রয়োজন হয়। কোম্পানিগুলো নিজেরাই জাহাজ কিনে ফেলছে। তাদের সেই সক্ষমতা তৈরি হয়েছে।
সরকারের নীতিসহায়তার মধ্যে রয়েছে ২০১৮ সালে শর্তসাপেক্ষে জাহাজ আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট/মূসক) অব্যাহতি দেওয়া, ২০১৯ সালে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজে ৫০ শতাংশ পণ্য পরিবহনের বাধ্যবাধকতা রেখে আইন প্রণয়ন করা, বড় জাহাজ আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া, দেশীয় জাহাজ বন্দরের জেটিতে ভেড়ানোর ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার এবং পুরোনো জাহাজ আমদানির সুযোগ দেওয়া। গত অর্থবছরের বাজেটে আগাম কর প্রত্যাহার, পুরোনো জাহাজের আয়ুষ্কাল ২২ বছরের পরিবর্তে ২৫ বছর এবং আমদানির পর বিক্রয়ের সময়সীমা ৫ বছরের পরিবর্তে ৩ বছর নির্ধারণ করা হয়।
জাহাজের নিবন্ধন প্রদানকারী সংস্থা নৌবাণিজ্য কার্যালয়ের মুখ্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পের বিকাশে সরকার অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। এই কারণেই মূলত উদ্যোক্তারাও এগিয়ে এসেছেন।
সমুদ্র পরিবহন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ২ হাজার ২১৩ জন নাবিক দেশীয় জাহাজে কর্মরত ছিলেন। তাতে ওই বছর নাবিকেরা আয় করেছেন ৬ কোটি ৬৬ লাখ ডলার (৫৬৬ কোটি টাকা)। জাহাজের সংখ্যা বাড়ায় এই আয়ও বাড়ছে। আবার এসব জাহাজে ১৬০ জন করে নতুন ক্যাডেট প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কর্মসংস্থান ছাড়াও ৮০টি জাহাজে পণ্য পরিবহন বাবদ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে।
উদ্যোক্তারা এ খাতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আরও কিছু নীতিসহায়তা চান। তাঁরা বলছেন, ১৯৯৪ সালে শিল্প মন্ত্রণালয় সমুদ্রগামী জাহাজ পরিবহন খাতকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এ সরকার কিছু নীতিসহায়তাও দিয়েছে। তবে এই খাত শতভাগ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করলেও অন্যান্য খাতের তুলনায় তা অনেক কম।
সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতির সভাপতি ও ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী এই শিল্পের বিকাশে দুটি প্রধান বাধা চিহ্নিত করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সমুদ্রপথে দেশি ও বিদেশি পণ্য পরিবহনে ভাড়ার আয়ের ওপর উদ্যোক্তাদের ৩ ও ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। বৈদেশিক মুদ্রা আয় করলে যেখানে প্রণোদনা দেওয়া হয়, সেখানে এই খাতে কর আরোপ বৈষম্যমূলক। তিনি বলেন, বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) আইনে সরকারি তহবিলের অর্থে আনা পণ্য সরকারি শিপিং করপোরেশনের মাধ্যমে পরিবহনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বেসরকারি খাতে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজ থাকার পরও সেখানে শুধু সরকারি সংস্থাকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি পক্ষপাতমূলক। এটা সংশোধন করা উচিত।
আজম জে চৌধুরী আরও বলেন, এসব বাধা দূর করা গেলে এই খাতে বিনিয়োগ বাড়বে।
দেশে বিগত অর্থবছরে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। পণ্য আমদানি-রপ্তানির ৮০ শতাংশ হয় সমুদ্রপথে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে ভাড়া বাবদ ব্যয় হয়েছে ৩৩৬ কোটি ডলার বা সাড়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা। সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতির হিসাবে জাহাজভাড়া অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এখন এই ব্যয়ের পরিমাণ তিন গুণে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ থেকে কনটেইনারে পণ্য রপ্তানির ভাড়া কমবেশি ৫০০ কোটি ডলার দাঁড়িয়েছে, যেটি পরিশোধ করছেন বিদেশি ক্রেতারা। দেশীয় জাহাজের সংখ্যা বাড়লে দুই থেকে তিন শ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রায় আয় সম্ভব।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবে নৌ খাতে আমাদের দক্ষ জনবল ছিল। ঘাটতি ছিল জাহাজের বহরের। এখন সেটিও বাড়ছে, এটা খুবই ইতিবাচক।’ তিনি বলেন, জাহাজে বাংলাদেশি বিনিয়োগ বাড়লে আমদানি-রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও বাড়বে। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে এই খাতে বিশেষ নজর দেওয়া যেতে পারে।