বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় ভারতই সাড়ে ১১ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে। এ অর্থ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯৭৮ কোটি টাকা (৮৫ টাকা ডলার ধরে)।
বাংলাদেশ এ ঋণ পাচ্ছে ভারতের তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায়। ২০১৭ সালের অক্টোবরে ভারতের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বাংলাদেশ সফরে এলে তৃতীয় এলওসি সই হয়। এর আওতায় মোট ঋণের প্রতিশ্রুতি ছিল ৪৫০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী জানান, ভারত সরকার ভারতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (আইএসইজেড) প্রতিষ্ঠার প্রকল্পে ঋণ দিতে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) আগেই অনুমোদন পেয়েছে।
২০১৫ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সমঝোতা স্মারক সই হয়।
শুরুতে ভারত কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ৪৬০ একর ও বাগেরহাটের মোংলায় ১১০ একর জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার আগ্রহ নিয়ে এগোচ্ছিল। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার আগ্রহ দেখায়। এখন আর বাকি দুই প্রকল্পে ভারতের তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। কাজ হচ্ছে মিরসরাই ঘিরে।
মিরসরাই, ফেনী ও সীতাকুণ্ড মিলিয়ে ৩০ হাজার একর জমিতে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে। মিরসরাইয়ে ভারতের জন্য জমি রাখা হয়েছে এক হাজার একরের মতো।
ভারতের পক্ষে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি উন্নয়নের কাজ পেয়েছে আদানি গ্রুপ। আদানির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান আদানি পোর্টস অ্যান্ড এসইজেডস কাজটি করছে। এ বিষয়ে বেজার সঙ্গে আদানির সমঝোতা স্মারক সই হয় ২০১৯ সালের ৪ অক্টোবর। আর গত ১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আদানিকে উন্নয়নকারী হিসেবে অনুমোদন দেয়।
বেজা জানিয়েছে, আদানির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ চুক্তির বিষয়টি দর কষাকষির মধ্যে রয়েছে।
২০১০ সাল থেকে ভারত লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বাংলাদেশকে তিন দফায় ৭৫০ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে এ অর্থায়ণের আওতায় প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ও ঋণের অর্থ ছাড়করণে ধীরগতি রয়েছে।
ভারতীয় এই ঋণের শর্ত মোটামুটি এ রকম যে প্রকল্পে ভারতীয় ঠিকাদারেরা কাজ পাবে। ঋণের টাকায় পূর্তকাজের প্রকল্প হলে ৬৫ শতাংশ মালামাল ভারত থেকে আনতে হবে। অন্য প্রকল্পে ৭৫ শতাংশ মালামাল ও সেবা ভারত থেকে আনতে হবে। প্রকল্পভেদে শর্তের ভিন্নতা রয়েছে। সুদের হার ১ শতাংশ আর প্রতিশ্রুতি মাশুল আধা শতাংশ। ৫ বছরের রেয়াতকাল সহ ঋণ পরিশোধের সময় ২০ বছর।
সাধারণত কম সুদের ঋণে এ ধরনের শর্তই থাকে। যেমন জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলে জাপানের ঠিকারদারেরাই কাজ পাচ্ছে।
বেজা জানায়, ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের ক্ষেত্রে ঠিকাদার ও পরামর্শক ভারতীয়। মালামাল আনার শর্ত নেই। কারণ অর্থনৈতিক অঞ্চলে মাটি ছাড়া তেমন কোনো মালামাল লাগে না। বেজা বলছে, মূল ঠিকাদার ভারতীয় হলেও সহঠিকাদার হিসেবে বাংলাদেশিরাও কাজ করবে।
বাংলাদেশ শুধু ভারতের নয়, জাপান ও চীনের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে। দুই ধাপে সেখানে মোট জমি দাঁড়াবে এক হাজার একরের মতো। আর চীন চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৭৮৩ একর জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে।
তিন দেশের জন্য এই অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য হলো, ওই সব দেশ থেকে বিনিয়োগ আনা। আর তিন দেশই নিজ নিজ দেশের বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে ঋণ দিচ্ছে। আবার অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মালিকানার একটি অংশ থাকছে বেজার হাতে। যেমন, জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বেজার হিস্যা ২৪ শতাংশ। আর চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে হিস্যা ৩০ শতাংশ। ভারতীয়দের ক্ষেত্রে এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক কাজের ক্ষেত্রে চীন ও জাপান এগিয়ে। এত বছরে ভারতের অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হয়ে যাওয়া উচিত ছিল কিনা জানতে চাইলে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, 'শুরুতে যে দুটি জায়গা নিয়ে কাজ চলছিল, তার চেয়ে ভারতের বিনিয়োগকারীরা মিরসরাইকে বেশি পছন্দ করেছেন। এ কারণে দেরি হয়েছে।'
ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পটির জন্য ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রয়েছে ৪০ কোটি টাকার কিছু বেশি। যার একটি অংশ ভারতীয় ঋণের টাকা। প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন কাজ আগামী বছর জুনে শেষ হবে। তবে করোনাপরিস্থিতির কারণে তা পেছাতে পারে বলে জানিয়েছেন বেজার কর্মকর্তারা।
বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার আওতায় চীন, রাশিয়া ও ভারত বিভিন্ন দেশকে ঋণ দিচ্ছে। ঋণদাতা হিসেবে তারা নতুন। তাদের সঙ্গে এ ধরণের ঋণের শর্তাদি, কাঠামো ইত্যাদি এখনো স্থির হয়নি। ফলে দেখা যায়, ঋণ ছাড়ের প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লেগে যায়।
গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, করোনা পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগ স্থানান্তরের একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সেটা হয়ত সময়ের ব্যাপার। তবে ওই সুযোগ ধরতে বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা দরকার। এ জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর কাজ দ্রুত এগিয়ে নেওয়া দরকার।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রতিবেশী অনেক দেশেই অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ টানতে বাংলাদেশ বিশেষ কী দিতে পারবে, সেটাও বিবেচনার।