ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আহমাদুল হক চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ জন্য প্রতি মাসে ১০ দিস্তার মতো কাগজ লাগে তাঁর। গতকাল রোববার রাজধানীর নীলক্ষেতে আসেন কাগজ কিনতে। তবে দাম বাড়ায় সাদা কাগজের বদলে তিনি কিনলেন নিউজপ্রিন্ট কাগজ।
আহমাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব সময় সাদা কাগজে লিখেছি। কিন্তু সাদা কাগজ প্রতি রিমে ১০০ টাকা বাড়তি। খরচ পোষাতে প্রথমবারের মতো নিউজপ্রিন্ট কাগজ নিলাম। এখন থেকে এটাতেই লিখতে হবে।’ গণিত অনুশীলনের জন্য তাঁর এত কাগজ লাগে বলে জানান তিনি।
রাজধানীর নীলক্ষেত, ফার্মগেট ও মোহাম্মদপুরের অন্তত ২০টি স্টেশনারি দোকান ঘুরে দেখা গেছে, শুধু সাদা কাগজ নয়, সব ধরনের শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূলত ঈদুল ফিতরের পর থেকে আমদানি করা শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়তে শুরু করে। এখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যেও সেই প্রভাব পড়েছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ছে।
স্টেশনারি দোকানগুলোতে ভালো মানের প্রতি রিম সাদা কাগজের খুচরা দাম রাখা হচ্ছে ৪৫০ টাকা। এক মাস আগেও যা ছিল ৩৬০ টাকা। মাঝারি মানের কাগজের (সাদা ও নিউজপ্রিন্ট মিলে তৈরি) দাম প্রতি রিম ৩৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আগে ছিল ২৮০ টাকা। নিউজপ্রিন্ট কাগজের দামও বেড়েছে প্রতি রিমে ৭০ টাকা। ১৮০ টাকা রিমের নিউজপ্রিন্ট এখন বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়।
কাগজের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে তৈরি খাতার দামে। সাদা কাগজের ৮০ পৃষ্ঠার খাতা এক মাস আগে ছিল ২০ টাকা, সেটা এখন ২৫ টাকা। একইভাবে বেড়েছে ১০০, ১২০ ও ২০০ পৃষ্ঠার খাতাও। দেশীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এসব খাতা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ১০ টাকা বেশিতে। ডজনে দেশি কলমের দাম বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত; ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৩-৫৫ টাকা। বিদেশি কলমের দামও বাড়তির দিকে।
নীলক্ষেতের সাউদিয়া স্টেশনারির মালিক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কাগজের দামের প্রভাব মোটামুটি সব ধরনের শিক্ষা উপকরণে পড়েছে। যেমন ৭২ পৃষ্ঠার একটি ব্যবহারিক খাতা ৪২ টাকা থেকে হয়েছে ৫২ টাকা। ১২০ পৃষ্ঠার খাতা ৫০ টাকা থেকে এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়।’
সাধারণ কলমের দাম তুলনামূলক কম বেড়েছে উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘কাগজ–কলম ছাড়া প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি শিক্ষা উপকরণের দামও বেশ বেড়েছে। সাধারণ মানের একটা জ্যামিতি বাক্স যেটা আগে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় পাওয়া যেত, সেটা এখন ৭৫ থেকে ৮০ টাকা; ভালো মানেরটা ১০০ টাকা থেকে হয়েছে ১৫০ টাকা। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের টু-বি পেনসিলের ডজন ৮০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৫ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক ফাইলের দাম বেড়েছে তিন থেকে পাঁচ টাকা।’
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোটাদাগে কাগজ-কলম-ফাইলের বাইরে রঙিন কাগজ, পেনসিল, শার্পনার, মুছনি (ইরেজার), মার্কার, স্ট্যাপলার, পিন, ক্লিপ, অফিস ফাইল, ক্যালকুলেটর, কলমের বক্স, স্টিল ও প্লাস্টিক স্কেল, রং–পেনসিল, অ্যান্টিকাটার, কাঁচি, আইকা, পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয় এমন ক্লিপবোর্ড, ছাপানোর কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য, প্রিন্টারের কালিসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কাজে ব্যবহৃত প্রায় সব উপকরণের দাম বেড়েছে।
এক মাসের ব্যবধানে শিক্ষা উপকরণের দাম সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে জানিয়ে মোহাম্মদপুর নুরজাহান রোডের ইসলামিয়া লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী শাহজাহান আলী প্রথম আলোকে বলেন, এখনো দাম বাড়তির দিকে। এরপরও বাজারে কাগজের সরবরাহ কম। এসব পণ্যের দাম এত দ্রুত বাড়ার কথা নয়। কেউ সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে কি না, সরকারকে সেটা নজরদারিতে আনতে হবে।
এই দোকানে কথা হলো মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা হোসেন আহমেদের সঙ্গে। তিনি জানালেন, চতুর্থ শ্রেণির একটি ব্যাকরণ বই নিয়েছিলেন ২২০ টাকায়। বইটাতে একটু সমস্যা থাকায় সেটা পরিবর্তন করতে এসেছেন। এর মধ্যে নতুন বই আসায় বাড়তি দাম দিতে হলো ৪০ টাকা। এভাবে শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়তে থাকলে অভিভাবকদের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কাগজ ও কালির দাম বাড়ায় আকারভেদে সব ধরনের বইয়ের দাম ২০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে বলে জানালেন নীলক্ষেতের মাস্টার লাইব্রেরির জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বললেন, এই সময় বইয়ের বড় ক্রেতা চাকরিপ্রত্যাশী ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়ারা। তাঁরা বাড়তি দামে নতুন বই কিনছেন না। এ জন্য পুরোনো বইয়ের চাহিদা বেড়েছে।
তবে সৃজনশীল বইয়ের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির চাপ তুলনামূলক কম বলে জানান বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বছরের এই সময়ে সৃজনশীল বইয়ের ক্রেতা কম থাকে। ছাপানোও কম হয়। তাই আমাদের ওপর এখনো চাপটা সেভাবে পড়েনি। তবে বাজারে কাগজের দাম বেশ চড়া। বাজেটে সরকার এ খাতকে কীভাবে দেখে, সেটার দিকে তাকিয়ে আছি।’