মুঠোফোন কোম্পানি বাংলালিংকের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান ভিওন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কান তেরজিওগ্লো গত সপ্তাহে ঢাকা সফর করেন। এ সময় তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে এই খাতের বিভিন্ন বিষয়সহ বাংলালিংকের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফয়জুল্লাহ।
প্রথম আলো: বাংলালিংক এখন কোন পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে?
কান তেরজিওগ্লো: এখন আমাদের প্রতি দুজন গ্রাহকের একজন ফোর–জি সেবা পাচ্ছেন। অর্থাৎ ৫০ শতাংশ গ্রাহককে আমরা ফোর–জির আওতায় নিয়ে আসতে পেরেছি। এটাকে শতভাগ করতে চাই। সুতরাং এখনই কিছু মানুষের জন্য ফাইভ–জি সেবা নয়, সব গ্রাহককে আরও উন্নত ফোর–জি সেবা প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি। ফাইভ–জি নিয়ে আমার বড় কোনো গৌরববোধ নেই। এখন অবধি শব্দটা শুনতে ভালো লাগলেও এর অভিজ্ঞতা খুব সুখকর মনে হয়নি।
আমরা নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করার পাশাপাশি গ্রামগঞ্জে উন্নত সেবা পৌঁছাতে চাই। এ জন্য আগামী দুই বছরে নতুন করে আরও সাত হাজার বেজ স্টেশন বা টাওয়ার স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছি। এর মধ্যে গত মাসে ৫০০ স্টেশন বসানো হয়েছে। কীভাবে ডেটার মূল্য আরও কমানো যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছি। আমরা ক্রমান্বয়ে টেলিকম কোম্পানি থেকে ডিজিটাল সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হতে চাই।
প্রথম আলো: সামনে তরঙ্গ নিয়ে নিলাম হবে। অন্য প্রতিযোগীরা আপনাদের আগে বাজারে ফাইভ–জি নিয়ে এলে পিছিয়ে পড়বেন কি না?
কান তেরজিওগ্লো: আপনি যখন ফোর–জি দিয়েই বাধাহীন ভিডিও দেখতে পারবেন, তখন নিশ্চয়ই আপনার ফাইভ–জির প্রয়োজন পড়বে না। কারণ, তখন আপনি উন্নত মানের ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছেনই। এ ছাড়া এমন নয় যে আরও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার থেমে থাকুক। বাংলালিংক ফাইভ–জি নিয়ে আসবে না, এমনও নয়। ফাইভ–জি সেবার প্রয়োজন অস্বীকার করার উপায় নেই। ব্যাপার হচ্ছে, এর আগে ফোর–জির নেটওয়ার্ক আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। তাহলে গ্রাহকেরা বিকল্প ভাববেন না। ফাইভ–জি ব্যবহারের অভিজ্ঞতা আমাকে খুব সুখকর কোনো স্মৃতি দেয়নি। তা ছাড়া বাংলাদেশে ফাইভ–জি স্মার্টফোনের সংখ্যাও কম।
অবশেষে তরঙ্গ নিলাম হচ্ছে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ খবর। এই নিলাম নিয়ে আমি আশাবাদী। কারণ, তরঙ্গের দাম এবার তুলনামূলক কম মনে হচ্ছে। তারপরও অবশ্য তা অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে আমাদের কৌশলগত পরিকল্পনা রয়েছে। এই নিলাম সেখানে কাজে আসবে। তবে আমরা কী করব, সে সম্পর্কে এখন কিছু বলছি না। আপাতত বলব, গ্রাহকদের কাছে আমাদের দায়বদ্ধতা আছে।
প্রথম আলো: টেলিকম থেকে ডিজিটাল কোম্পানিতে রূপান্তরের কথা ভাবছেন, কিন্তু কেন?
কান তেরজিওগ্লো: একটা সময় আসবে যখন মানুষ নানা অ্যাপস ব্যবহার করে ফোনে যুক্ত থাকবে। এ দেশের মানুষ ক্রমেই ডিজিটাল সেবায় আগ্রহী হচ্ছে। আগামী দিনে এটা আরও বাড়বে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আর্থিক সেবার মতো বিষয়গুলো মুঠোফোনে চলে আসছে। গ্রাহকদের চাহিদার কথা ভেবে আমরাও অনলাইনে স্বাস্থ্যসেবা চালু করেছি। তাতে আমাদের অ্যাপসের ব্যবহার বাড়ছে। ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের প্ল্যাটফর্ম টফি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
প্রথম আলো: ১৭ বছর ধরে ব্যবসা করছেন, বিনিয়োগের পরিমাণও বেশ, কিন্তু লাভ করতে পারছেন না কেন?
কান তেরজিওগ্লো: কোম্পানি হিসেবে আমাদের মুনাফা করা উচিত। তবে আমরা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে বিশ্বাসী। বাংলাদেশে আমাদের বাজার বেশ মজবুত। সময় বেশি লাগলেও আমাদের বিশ্বাস, এই বাজার থেকে আমরা একসময় ভালো মুনাফা করতে পারব। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার হওয়ায় বিনিয়োগ চলমান রেখেছি। আমরা এ পর্যন্ত প্রায় চার বিলিয়ন (৪০০ কোটি) মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছি। প্রতিবছর ২০–৩০ কোটি ডলারের মতো বিনিয়োগ চলমান আছে। আগামী দিনে আরও বিনিয়োগ আসবে।
প্রথম আলো: শেয়ারবাজারে কবে আসছেন?
কান তেরজিওগ্লো: বিষয়টি এখনই বললে বেশ তড়িঘড়ি হয়ে যায়। শেয়ারবাজারে আসতে নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তবে এবার আমি নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বসেছি। ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে হয়তো আরও বছর তিনেক পরে আমরা শেয়ারবাজারে আসার বিষয়টি জানাতে পারব। আমাদের লক্ষ্য আছে, সময় ও পরিস্থিতি বলে দেবে এটা কখন ঘটবে।
প্রথম আলো: এই সময়ে টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা কী?
কান তেরজিওগ্লো: বাংলাদেশে টেলিকম খাতের মোট রেভিনিউর ৫০ শতাংশের বেশি একটা কোম্পানির হাতে। তাই ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকিয়ে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের উচিত টেলিকম খাতের এসএমপি নীতিমালা ভালোভাবে বাস্তবায়নে এগিয়ে আসা। এর ফলে অন্য টেলিকম কোম্পানিগুলোর টিকে থাকতে যেমন সহায়ক হবে, তেমনি গ্রাহকেরাও বাড়তি সুবিধা পাবেন।
এ ছাড়া বাংলাদেশে টেলিকম খাতে কর বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এই খাতে ট্যাক্স কমিয়ে আনা প্রয়োজন। এটা করা গেলে প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের আরও ভালো সেবা দিতে পারবে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করলেন?
কান তেরজিওগ্লো: কোভিড সংক্রমণের ঠিক আগে আমি বাংলাদেশে এসেছিলাম। তখন রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে এত জমজমাট ব্যবসা চোখে পড়েনি। এবার এসে দেখলাম, খুচরা বিক্রি বেশ ভালো। রাস্তার আশপাশের দোকানগুলো বেশ সচল। স্থানীয় ব্র্যান্ডের সঙ্গে বিদেশি অনেক ব্র্যান্ডের দোকানও চোখে পড়ল।