যদি কোনো প্রতিষ্ঠান নতুন একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে একই পরিমাণ পণ্য আগের চেয়ে খানিকটা সস্তায় বিক্রি করে, তাহলে কিন্তু দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কমে যাবে এবং মাথাপিছু মোট আয়ও কমবে।
উদাহরণটা যাঁদের কাছে পরিষ্কার হলো না, তাঁদের জন্য আরও সহজ করে বলেছেন ড. আকবর আলি খান। ধরা যাক এক দ্বীপরাজ্যে ১০০ তরুণ বাস করেন। তাঁরা প্রত্যেকে বছরে আয় করেন ১ কোটি টাকা। তাঁদের প্রত্যেকেরই একজন করে নারী সহকারী আছেন, তাঁদের বেতন বছরে ১ লাখ টাকা। সুতরাং এই রাজ্যের জিডিপি হচ্ছে ১০১ কোটি টাকা আর মাথাপিছু আয় ৫০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। একা একা আর কত দিন থাকা যায়। প্রতিটি তরুণ তাঁদের সহকারীকে বিয়ে করে সংসারী বানিয়ে ফেললেন। এতে ১০০ তরুণেরই সুখ বেড়ে গেল, কিন্তু রাজ্যের মাথাপিছু আয় কমে হলো ৫০ লাখ টাকা, কারণ সহকারীরা এখন আর বেতন পান না।
সুখ চিরস্থায়ী হয় না। একদিন বড়সড় সড়ক দুর্ঘটনায় ১০ জন স্ত্রী মারা গেলেন, ১০ জন স্বামী একটি করে পায়ের আঙুল হারালেন, আর ২০ জনকে হাসপাতালে থাকতে হলো দীর্ঘদিন। এতে রাজ্যের সুখ কমে গেল, দুর্দশা বাড়ল। অথচ রাজ্যের পরিসংখ্যান ব্যুরো বেশ ঘটা করে জানাল তাদের জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে, প্রবৃদ্ধির হারও বেশ আকর্ষণীয়। হিসাবটা হচ্ছে লোকসংখ্যা কমেছে ১০ জন, হাসপাতালের আয় ও গাড়ি মেরামতকারীদের আয় বেড়েছে। এ এক অদ্ভুত অবস্থা। সুখ যখন বাড়ে তখন মাথাপিছু আয় কমে যাচ্ছে, আর আয় বাড়লেও সুখ কমে যাচ্ছে।
এই যেমন বাংলাদেশ। প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, মাথাপিছু আয়ও বাড়ছে। কিন্তু সুখ? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘তুমি সুখ যদি নাহি পাও/ যাও সুখের সন্ধানে যাও।’ সেটা কীভাবে—এই উত্তর দিতে হবে এখন নীতিনির্ধারকদেরই। যদিও ঘটছে উল্টোটা। উদাহরণ দিই—
চামড়া নিয়ে দেশে অনেক কিছু ঘটে গেল। দাম না পেয়ে চামড়া ফেলে দিলেন কেউ কেউ। এরপর তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো কাঁচা চামড়া রপ্তানির। এতেও কিন্তু দেশের জিডিপি বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ীরা এখন কাঁচা চামড়া রপ্তানি করবেন। এতে দেশের রপ্তানি আয় বাড়বে, যা জিডিপিতে যুক্ত হবে। আবার ট্যানারিমালিকেরা জুতা, ব্যাগসহ নানা ধরনের চামড়াজাত পণ্য বানাতে বিদেশ থেকে বেশি দরে চামড়া আমদানি করবেন। এতে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে বলা যাবে, বিনিয়োগ বাড়ছে তা–ও বলা যাবে। এই দুটো নিয়েই তো সমস্যায় আছে বাংলাদেশ।
এরপরে দেশীয় শিল্প সংরক্ষণের কথা বলে যদি চামড়া আমদানির ওপর বাড়তি শুল্ক বসানো যায় তাহলে তো আরও লাভ, বাড়বে রাজস্ব আয়। এমনিতেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে আছে নানা সন্দেহ। কারণ, উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে স্থবির বিনিয়োগ এবং নিম্ন রাজস্ব আয়ের মিল পাওয়া যায় না। এবার যদি এর কিছুটা সুরাহা হয়।
সুতরাং সরকারের নজরদারির অভাব, বিসিকের অদক্ষতা, ব্যবসায়ীর কারসাজি এবং সবশেষে চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ীদের বড় অংশের সুখ কমলেও জিডিপি তাতে অবশ্যই বাড়বে। এটাই বা কম কিসে।
গল্প তো হলো, এবার তাহলে খানিকটা অর্থনীতি শেখা যাক।
মোট জাতীয় উৎপাদন (জিএনপি)
কোনো নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত এক বছরে কোনো দেশের জনগণ মোট যে পরিমাণ চূড়ান্ত দ্রব্য বা সেবা উৎপাদন করে, তার অর্থমূল্যকে মোট জাতীয় উৎপাদন বলে। জাতীয় উৎপাদনের মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী ও কর্মরত বিদেশি ব্যক্তি ও সংস্থার উৎপাদন বা আয় অন্তর্ভুক্ত হবে না। তবে বিদেশে বসবাসকারী ও কর্মরত দেশি নাগরিক, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বা আয় অন্তর্ভুক্ত হবে। সুতরাং বাংলাদেশের নাগরিকেরা যে যেখানেই থাকুক, তাদের উৎপাদন বা আয় জিএনপিতে অন্তর্ভুক্ত হবে।
মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)
মোট দেশজ উৎপাদন হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত এক বছরে কোনো দেশের অভ্যন্তরে বা ভৌগোলিক সীমানার ভেতরে বসবাসকারী সব জনগণ কর্তৃক উৎপাদিত চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্মের অর্থমূল্যের সমষ্টি। এতে উক্ত সীমানার মধ্যে বসবাসকারী দেশের সব নাগরিক ও বিদেশি ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্মের মূল্য অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে বিদেশে অবস্থানকারী ও সেখানে কর্মরত দেশের নাগরিক বা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের আয় অন্তর্ভুক্ত হবে না। সুতরাং জিডিপির ক্ষেত্রে ভৌগোলিক সীমানাটাই প্রধান।