বিদেশ থেকে বৈধ উপায়ে দেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রবাসীদের সামান্য একটু সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। শেষ দুই বছরে এমন অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেও তিনি কিন্তু কাজটি করে যেতে পারেননি। নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন।
শেষ পর্যন্ত আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটেই এ বিষয়ে একটি ঘোষণা থাকছে। প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) দেশে পাঠানোর খরচ বহনে আগামী বাজেটে ভর্তুকি বাবদ তিন হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এতে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠানোর প্রবণতা ও পরিমাণ কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গত সপ্তাহে বাজেট নিয়ে কথা বলতে যান অর্থমন্ত্রী। তখন তাঁকে প্রধানমন্ত্রী প্রবাসী আয়ের খরচ কমাতে ভর্তুকি রাখার পরামর্শ দেন। তবে আপাতত বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, তবে কোন প্রক্রিয়ায় বা কীভাবে প্রবাসীদের টাকা দেওয়া হবে, তা এখনো ঠিক করা হয়নি। বাজেটের পর আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করে সবকিছু চূড়ান্ত করা হবে।
তবে প্রবাসী আয় আকর্ষণে সরকারের নেওয়া নতুন এই উদ্যোগকে ভিন্নভাবে দেখছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা একটা ভুল পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে। উত্তম পদক্ষেপ হতে পারত টাকার অবমূল্যায়ন করা। এতে রপ্তানি বাড়ত, আমদানি কমত এবং প্রবাসী আয় বাড়ত।’
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, প্রাথমিকভাবে প্রবাসী আয়ের বিপরীতে ২ থেকে ৩ শতাংশ টাকা দেওয়ার কথা চিন্তা করা হয়েছে। অর্থাৎ যে পরিমাণ প্রবাসী আয় কেউ পাঠাবেন, তা যদি ১০০ টাকার সমান হয়, তাহলে তাঁর পরিবার পাবে ১০২ থেকে ১০৩ টাকা। যে বাড়তি টাকা তাঁদের দেওয়া হবে, সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোকে তা দিয়ে দেওয়া হবে। এ জন্যই বাজেটে ভর্তুকি রাখা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে বৈধ পথে ১ হাজার ৪৯৮ কোটি মার্কিন ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ সোয়া লাখ কোটি টাকা মতো। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ৩৩০ কোটি ডলার। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছিল ২০১৪-১৫ অর্থবছরে, যা পরিমাণে ১ হাজার ৫৩১ কোটি ডলার।
আগামী বাজেটে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি রাখা হতে পারে।
দেশে আয় পাঠাতে যে খরচ হয়, তা বহনে এই টাকা ব্যয় হওয়ার কথা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাজ্য—এই ছয় দেশ থেকেই দুই-তৃতীয়াংশ রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় দেশে আসে। ঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বাংলাদেশের বাইরে বিশ্বের সব দেশ মিলিয়ে যে পরিমাণ বাংলাদেশি থাকেন, তার সংখ্যা ৮০ লাখ বলে ধরা হয়। যাঁদের বলা হয় বাংলাদেশের বাইরে আরেকটি বাংলাদেশ। আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবাসী আয়ের অবদান ধরা হয় ১০ শতাংশের বেশি।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক উপায় বা অবৈধ পথ ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ ঘটনা বেশি ঘটছে এবং দেশগুলোতে মোবাইল ব্যাংকিং পদ্ধতির ব্যবহার বেশি হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং ও হুন্ডির ব্যবহার অনেক বেড়েছে। এর একটি কারণ হতে পারে দেশে দেশে দ্রুত অর্থ পাঠানোর সুবিধা ও কম খরচ। এ ছাড়া রয়েছে বিনিময় হারের পার্থক্য। অর্থাৎ বিদেশ থেকে মোবাইল ব্যাংকিং ও হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠালে দেশে যে পরিমাণ টাকা দেওয়া হয়, তার চেয়ে কম পাওয়া যায় বৈধ বা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠালে। সে জন্য অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেল এড়িয়ে অবৈধ উপায়ে দেশে অর্থ পাঠানোর পথে হাঁটেন।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনো বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস প্রবাসী আয়, যা মোট ঋণ ও বিদেশি বিনিয়োগের চেয়েও বেশি। তা ছাড়া বাংলাদেশের পল্লি অঞ্চলের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী এই প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল।
এদিকে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অনুসন্ধানেও উঠে আসে যে মোবাইল অ্যাপসের ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশে বৈধ উপায়ে প্রবাসী আয় আসা কমছে। কারণ, মোবাইল অ্যাপস হুন্ডির মাধ্যমে টাকা লেনদেনে সহায়ক। এ কারণে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার লেনদেনসীমা তখন কমিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে আরও বলেন, নির্দিষ্ট একটি খাতকে অগ্রাধিকার দিলে অন্য খাতও একই সুবিধা চাইবে। তখন সিরিয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। সিরিয়ায় একসময় ১৫০টির মতো বিনিময় হার ছিল, যেটাকে বলা যেতে পারে আইনের জঙ্গল।