ঢাকার দরজি দোকানগুলোয় এ সময় রাত–দিন সেলাই মেশিনের ঘর্ঘর শব্দে মুখর থাকার কথা। কিন্তু সেগুলোর ঝাঁপ বন্ধ। স্তব্ধ, নীরব। গুলিস্তান এলাকার ঝাঁপ বন্ধ দরজির দোকানগুলোর সাইনবোর্ডে থাকা সেল নম্বরে ফোন করে মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রায় দুই মাস হতে চলল তাঁদের দোকান-কারখানা সব বন্ধ। কারিগরদের বেতন দিতে পারছেন না, তাঁদের বাড়িতে খাবার নেই। মালিকদের লাখ লাখ টাকা লোকসান হচ্ছে। ধারকর্জও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে দিন পার করছেন।
গতকাল সোমবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আপ-টু-ডেট টেইলার্সের মালিক নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানালেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে ৩ জন কাটিং মাস্টার ও ২০ জন সেলাইয়ের কারিগরসহ মোট কর্মচারী ২৫ জন। দোকান ভাড়া বেতন, ভ্যাট, ইলেকট্রিক বিলসহ মোট মাসিক খরচ প্রায় দেড় লাখ টাকা। গত ২৪ মার্চ থেকে দোকান বন্ধ। এখন ঈদের মৌসুম। এ সময়ই বছরের প্রধান আয় হয়ে থাকে। এবার আয় দূরে থাক, কর্মচারীদের বেতন দেওয়াটাই তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। এরপর নিজের সংসারের খরচ তো আছেই। অবর্ণনীয় অবস্থা। টিকে থাকার এক কঠিন পরীক্ষা চলছে। এই পেশায় প্রায় ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানালেন, ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় একটা বড় সংকট হয়েছিল। প্রায় দুই সপ্তাহের মতো দোকান বন্ধ রাখতে হয়েছিল। কিন্তু এখন পুরো অনিশ্চিত অবস্থা। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, কেউ জানে না।
একই রকম অভিজ্ঞতার কথা বললেন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সলিমাবাদ ভবনের ম্যাপ’স রুমা টেইলার্স অ্যান্ড ফেব্রিকসের মালিক আজমল হোসেন। তাঁদের চারজন অংশীদারের বেশ বড় এই প্রতিষ্ঠান। প্রায় ৪০ জন কর্মচারী। বেতন, ভাড়া ও আনুষঙ্গিক মিলিয়ে মাসে সাড়ে তিন লাখের ওপর খরচ। আয় বন্ধ। কর্মচারীরা বাড়ি চলে গেছেন। বহু বছরের স্থায়ী কর্মচারী। হুট করে ছেড়ে দেওয়া যায় না। তাঁরা দুরবস্থার কথা বলে টেলিফোন করতে থাকেন। ফলে নিজেদের অবস্থা যেমনই হোক, বিকাশে কিছু কিছু করে টাকা পাঠাতে হয়। এভাবে আর কত দিন চলবে, কিছুই ভাবতে পারছেন না।
মালিবাগের আনারকলি মার্কেটের নিউ সানমুন টেইলার্স অ্যান্ড ফেব্রিকসের মালিক অরবিন্দ শেখর পান্ডে বললেন, স্বাভাবিক সময় তাঁদের এখানে শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি মিলিয়ে প্রতি মাসে চার শর মতো ফরমাশ আসে। ঈদের সময় তা বেড়ে এক থেকে দেড় হাজারে ওঠে। প্রায় দুই মাস হতে চলল দোকান বন্ধ। ৩২ জন কর্মচারী, মাসে দুই লাখের ওপরে খরচ। প্রায় চার লাখ টাকা পুঁজির ক্ষতি হয়ে গেছে। এটা কীভাবে পূরণ হবে জানা নেই। বলছিলেন, ‘মনে হয় সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে পালিয়ে যাই। যে সর্বনাশ হয় গেল তা পূরণ হবে না। অনেকে হয়তো আর উঠে দাঁড়াতেই পারবে না।’
নারীদের পোশাক তৈরির দোকানগুলো নিউমার্কেট-গাউছিয়া এলাকাতেই বেশি। সেখানে খোঁজ নিয়েও একই অবস্থা দেখা গেল। দোকান বন্ধ। গাউছিয়া এলাকার নূর ম্যানশনের পুরোনো টেইলার্সগুলোর একটি হলো ‘মহানগর টেইলার্স’। এর মালিক সোহরাব হোসেন জানালেন, ১৯৮৪ সাল থেকে এখানে তাঁর ব্যবসা। কর্মচারী ৩০ জন। ব্লাউজ, সায়া, থ্রি–পিস, লেহেঙ্গা, ফ্রক, গাউন এসব তৈরি করেন তাঁরা। ঈদে ব্যতিক্রমী পোশাকের জন্য অনেকে কাপড় কিনে নিজস্ব নকশায় তাঁদের কাছে পোশাক তৈরি করাতে আসেন। সাধারণত শবে বরাতের পর থেকেই ফরমাশ নেওয়া শুরু হয়। ১০ রোজার পর ফরমাশ নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এই দেড় মাসে মালিক, কর্মচারী কারও দম ফেলার সময় থাকে না। ২৪ ঘণ্টা দোকান-কারখানা খোলা থাকে। এ সময় কারিগরেরা কারখানাতেই থাকেন। তাঁদের রাতের খাবার, সাহ্রি, ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। সবারই দ্বিগুণ বা তারও বেশি আয় হয়। এবার কেবল লোকসান আর লোকসান। দোকান খোলারও ভরসা পাচ্ছেন না। কার না কার থেকে করোনার সংক্রমণ ছড়াবে, কিছু বলা যায় না। তখন জীবন সংশয় হয়ে পড়বে। দরকারি চিকিৎসাও পাওয়া যাচ্ছে না। এখন তবু টাকার ওপর দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু দোকান খুলে ৩০-৩৫ জন মানুষের জীবনের ঝুঁকি নিতে রাজি নন তিনি।
গাউছিয়া এলাকায় নূর ম্যানশনে মহিলাদের পোশাকের দরজি দোকান প্রায় ৩০টি। গাউছিয়ায় এখন দোকান কম, পাঁচ–সাতটি। সবচেয়ে বেশি দোকান ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সে। এখানে দোকান ১২৪টি। এ ছাড়া আশপাশের মার্কেটগুলোতে অল্প কিছু আছে। সব মিলিয়ে এই এলাকায় দরজি দোকান দুই শর কাছাকাছি। দোকানে গড়ে ১৫ জন করে ধরলে, এখানেই তিন হাজারের বেশি কর্মচারী। তাঁদের পরিবারের অবস্থা অবর্ণনীয়।
কথা হলো মহানগর টেইলার্সের কাটিং মাস্টার মো. আলমের সঙ্গে। তিনি জানালেন, সোনারগাঁয়ে নিজের বাড়িতে চলে গেছেন। পাঁচ সদস্যের পরিবার। চুক্তিতে কাজ করতেন, মাসে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হতো। ঈদের সময় হতো ৫০-৬০ হাজার টাকা। এখন তো বাজার করারই টাকা নেই। মালিককে প্রায়ই ফোন করেন। তিনি বিকাশে কিছু কিছু পাঠান। আসলে মালিকের ওপরেও চাপ দিতে পারছেন না। কারণ, ওনার তো আয় নেই। আরও অনেক কর্মচারী আছে, তাঁদেরও দিতে হচ্ছে। রাস্তায় নেমে সাহায্যের জন্যও হাত পাততে পারছেন না। পরিস্থিতি এমন যে এখন কারও কাছে ধারকর্জ চাইলেও পাওয়া যায় না। সবাই অভাব–অনটনের মধ্যে আছেন। দিন দিন সংসার চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়ছে।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হলো টেইলার্স মালিকদের সংগঠন ড্রেস মেকার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ–এর ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক বি এম হারুনার রশিদের সঙ্গে। গুলিস্তানের খ্যাতনামা রমনা ভবনের মিডল্যান্ড টেইলার্সের মালিক তিনি। বহু বছর এই পেশায় আছেন। তিনি জানালেন, ঢাকায় ড্রেস মেকারদের সংগঠন খুব শক্তিশালী নয়। মহিলাদের পোশাক যাঁরা তৈরি করেন, তাঁদের প্রায় ৯০ ভাগই সংগঠনভুক্ত নয়। বেশির ভাগই টেইলার্স মালিক তাঁদের নিজ নিজ মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে তাঁদের সংগঠনভুক্ত টেইলার্সের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। তাঁর হিসাব অনুসারে ছোট–বড় মিলিয়ে ঢাকা মহানগরীতে এখন টেইলার্সের সংখ্যা পাঁচ হাজারের মতো হতে পারে। দোকানপ্রতি ১০ জন করে কারিগর ধরলে প্রায় ৫০ হাজার জনবল এর সঙ্গে যুক্ত। এর সঙ্গে আরও ৫ থেকে ৭ হাজার আছে মালিক। সব মিলিয়ে ৬০ হাজারের মতো হতে পারে। এই পরিবারগুলোর এখন অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম চলছে। কারিগরেরা কষ্টে আছেন। তাঁরা তবু মালিকের কাছে টাকা চাইতে পারছেন। কিন্তু মালিকেরা কার কাছে হাত পাতবেন? এই ব্যবসা এমন নয় যে মাসের পর মাস ভর্তুকি দিয়ে চলবে। তিনি বলেন, তাঁর কাছে খবর আছে, অনেক ছোট টেইলার্স মালিক এখন স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। অনেকে আর মালিক থাকতে পারবেন না। দোকান ছেড়ে দিয়ে শ্রমিক হয়ে যাবেন।
ড্রেস মেকার্স অ্যাসোসিয়েশন ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের অন্তর্ভুক্ত। হারুনার রশিদ জানালেন, এফবিসিসিআইয়ের নেতাদের সঙ্গে তাঁরা এর মধ্যে আলোচনায় বসেছিলেন। সরকারঘোষিত প্রণোদনা থেকে ড্রেস মেকারদের সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে তাঁরা প্রস্তাব দিয়েছেন। তা ছাড়া দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, ১০ শতাংশ ভ্যাট—এসব তাঁদের একটা বড় সমস্যা। এগুলো মওকুফ করা হলে তাঁরা এই মারাত্মক সংকট কাটিয়ে উঠতে কিছুটা সহায়তা পেতেন। এসব নিয়েই ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। তবে এই সংকট কত দীর্ঘ হবে, আর সহায়তাই বা কতটা পাওয়া যাবে, সবকিছুই অনিশ্চিত। দিনে দিনে প্রবল হচ্ছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংকট।