গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে ২০ বছর চাকরি করেছেন। বয়সও হয়েছে। ছেলে বিদেশে থাকেন। এখন সপরিবার ছেলের কাছে স্থায়ীভাবে চলে যাবেন। তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এত দিন চাকরি করার ফলে গ্র্যাচুইটি বা আনুতোষিক হিসেবে প্রায় ২৫ লাখ টাকা পেলেন।
এই টাকা করমুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি যখন টাকাটা তুলতে গেলেন, তখন বিপত্তি বাধল। সেই টাকার ২৫ শতাংশ হারে কর কেটে রাখা হলো। কারণ, রফিকুল ইসলামের সাবেক প্রতিষ্ঠান গ্র্যাচুইটির টাকা যে তহবিলে আলাদা করে রেখেছে, তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়নি। ২৫ লাখ টাকার পরিবর্তে রফিক সাহেব হাতে পেলেন সাড়ে ১৭ লাখ টাকা। ভাবুন তো, রফিক সাহেবের মনের অবস্থা তখন কেমন হয়েছিল? এই টাকায় কত কিছু করার স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি।
শুধু প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে অবসরে যাওয়া কিংবা চাকরি ছেড়ে দেওয়া কর্মীদের এমন ভোগান্তি হয়ে থাকে, তাঁরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। অথচ যেই টাকা করমুক্ত থাকার কথা, সেটির দায়ভার কর্মীকে নিতে হবে প্রতিষ্ঠানের ভুলের কারণে।
২০২০–২১ অর্থবছরের বাজেটে গ্র্যাচুইটি ও পেনশন নিয়ে আয়কর খাতে এমন পরিবর্তন আনা হয়েছে। অর্থবিলের দফা ৫১-তে বলা হয়েছে, সরকার বা অন্য কোনো অনুমোদিত গ্র্যাচুইটি তহবিল থেকে আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত গ্র্যাচুইটির টাকা পেলে কোনো কর দিতে হবে না। তবে যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে যে তহবিল বা ব্যাংক হিসাবে গ্র্যাচুইটির টাকা রাখা হয়, তা এনবিআরের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। বার্ষিক রিটার্নে ওই তহবিলের লেনদেন আলাদা করে দেখাতে হবে। তা না হলে গ্র্যাচুইটির টাকা করমুক্ত হবে না।
একইভাবে পেনশনের টাকা প্রদানের ক্ষেত্রেও তহবিলের অনুমোদন নিয়ে রাখতে হবে। তা না হলে পেনশনের টাকার ওপরও কর বসবে। গ্র্যাচুইটির টাকার মতো অবশ্য পেনশনের টাকায় কোনো সীমা দেওয়া হয়নি। এত দিন শুধু বলা হয়েছিল, যেকোনো গ্র্যাচুইটি বা পেনশন ফান্ড থেকে চাকরিজীবীকে টাকা দিলে কর দিতে হবে না। এখন তহবিল অনুমোদনের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই এনবিআর এই শর্ত দিয়েছে।
>গ্র্যাচুইটি ও পেনশন তহবিল এনবিআরের অনুমোদিত হলেই কেবল করমুক্ত সুবিধা মিলবে। প্রতিষ্ঠানের দায় পড়বে কর্মীর ওপর।
এর পেছনের কারণ কী—এটা জানার চেষ্টা করা হয়। এনবিআরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্মীদের পেনশন ও গ্র্যাচুইটি সুবিধা দেয়, এমন বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই আলাদা তহবিলে বা ব্যাংক হিসাবে পেনশন ও গ্র্যাচুইটির টাকা রাখা হয়। এসব তহবিল মালিকপক্ষই পরিচালনা করে থাকে। তাই এই তহবিল থেকে অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা টাকা তুলে নেন, আবার হয়তো জমাও করেন। এতে ওই সব তহবিলের স্বচ্ছতা থাকে না। ঝুঁকিতে পড়ে তহবিল ব্যবস্থাপনা। গ্র্যাচুইটি–সুবিধা থাকলেও বহুদিনের জন্য টাকা আটকে যাওয়ার শঙ্কায় অনেক প্রতিষ্ঠানের এমন আলাদা তহবিল নেই।
তহবিল ব্যবস্থাপনা
পেনশন বা গ্র্যাচুইটি তহবিল এনবিআর থেকে অনুমোদন করিয়ে নিলে কর্মীদের করে যেমন ছাড় আছে, তেমনি তহবিল পরিচালনায় নজরদারিও বাড়ানো সম্ভব হয়। যেমন এনবিআর থেকে তহবিল বা ব্যাংক হিসাব অনুমোদন করিয়ে নিলে শর্ত অনুযায়ী তহবিলটি ট্রাস্টের মাধ্যমে চলবে, যেখানে মালিক ও কর্মী—উভয় পক্ষের প্রতিনিধি থাকবেন। ফলে তহবিল ব্যবস্থাপনা কিছুটা নজরদারিতে চলবে।
অন্যদিকে আলাদা তহবিলে গ্র্যাচুইটির টাকা রাখার ফলে প্রতিবছর এনবিআরে ওই প্রতিষ্ঠান যে বার্ষিক কর বিবরণী জমা দেবে, সেখানে এই তহবিল থেকে কত টাকা, কোথায় খরচ হয়েছে, তা বিস্তারিত জানাতে হবে। ফলে ওই প্রতিষ্ঠানের কতজন কর্মীকে পেনশন বা গ্র্যাচুইটির টাকা দেওয়া হলো, তা জানা যাবে। এই তহবিলের টাকা অন্য খাতে খরচ হলে সেই তথ্যও প্রকাশ পাবে। টাকা লেনদেনের বিস্তারিত জানতে পারবে এনবিআর।
মালিকদের লাভ কী
মালিকদেরও লাভ আছে। গ্র্যাচুইটির তহবিলে মালিকপক্ষ কর্মীর মূল বেতনের বিপরীতে টাকা রাখে। বছর শেষে এই টাকা আয়কর বিবরণী প্রস্তুত করার সময় খরচ হিসেবে দেখাতে পারে। উদাহরণ দিয়ে বলা যেতে পারে, একটি প্রতিষ্ঠান তার ৫০০ কর্মীর বিপরীতে বছরে ১ কোটি টাকা গ্র্যাচুইটি হিসেবে রাখল। ওই প্রতিষ্ঠান নিজের আয় থেকে এই টাকা গ্র্যাচুইটি তহবিলে রাখে। কিন্তু বছর শেষে যখন ওই প্রতিষ্ঠান রিটার্ন জমা দেবে, তখন এই টাকা খরচ হিসেবে দেখাবে। এতে ওই এক কোটি টাকার ওপর কোনো করপোরেট কর বসবে না।
একইভাবে প্রভিডেন্ড ফান্ডের ক্ষেত্রেও কর্মীর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানও সমপরিমাণ অর্থ প্রভিডেন্ড তহবিলে প্রতি মাসে রাখে। প্রতিষ্ঠানের সেই টাকাও করমুক্ত থাকবে।
গ্র্যাচুইটির টাকা কীভাবে হিসাব করা হয়
গ্র্যাচুইটি–সুবিধা হলো চাকরিজীবীর একধরনের সামাজিক সুরক্ষাসুবিধা। চাকরিজীবন শেষে গ্র্যাচুইটির টাকা কোথাও বিনিয়োগ করে সংসার চালান অনেক অবসরভোগী। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও কর্মীদের গ্র্যাচুইটি–সুবিধা দেয়। কর্মীর জন্য প্রতিষ্ঠান এই টাকা আলাদা করে রাখে। অবসর নেওয়ার সময় কিংবা চাকরি ছাড়ার সময় চাকরির মেয়াদ অনুসারে গ্র্যাচুইটির টাকা হিসাব করা হয়। প্রথম দু-তিন বছর বাদে সাধারণত চাকরিজীবীর প্রতি এক বছরের জন্য দুই মাসের মূল বেতনের সমান গ্র্যাচুইটির টাকা পাওনা হন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে এর ব্যতিক্রমও আছে।
জানতে চাইলে এনবিআরের প্রথম সচিব (আয়কর নীতি) ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ মামুন প্রথম আলোকে বলেন, গ্র্যাচুইটি ও পেনশন তহবিল এনবিআরের অনুমোদিত হলে প্রতিষ্ঠান ও কর্মী—উভয়েই লাভবান হবে। প্রতিষ্ঠানের কর কমবে, আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। আবার কর্মী যখন এই টাকা পাবেন, তখন তাঁকে কর দিতে হবে না।
৯৩ লাখ লোক আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৭ অনুযায়ী, দেশের ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন ৯৩ লাখ নারী-পুরুষ। আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা ব্যক্তিদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ২০ লাখের মতো। বাকি ৭০ লাখ বেসরকারি খাতে কাজ করেন। যেহেতু আনুষ্ঠানিক খাতের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তাঁদের গ্র্যাচুইটি, পেনশন, প্রভিডেন্ড ফান্ডসহ সব ধরনের সুবিধা থাকার কথা। তবে বহু প্রতিষ্ঠানে এসব সুবিধা নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করে সুবিধা সীমিত করে দেয়। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) সূত্রে জানা গেছে, দেশে দেড় লাখের মতো কোম্পানির নিবন্ধন আছে।
আরও পড়ুন:
খারাপ কাজ হয়েছে