খামারের সামনে বসে আছেন খামারি। কর্মীরা খুঁজে দেখছেন কোনো মুরগি নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে কি না। কিংবা কয়টা মুরগি মারা গেল। প্রতিদিনই দলে দলে মরে যাচ্ছে যত্নের মুরগিগুলো। আক্রান্ত হয়েছে রানীক্ষেত রোগে। সাড়ে তিন হাজার মুরগি ছিল। কিন্তু এখন দেড় হাজারের কম। কর্মীরা দৌড়াদৌড়ি করেন, এলাকার পশুচিকিৎসক বা সুপারভাইজারের কাছে যান। সবার সমাধান একটাই—মুরগিকে ইনজেকশন দাও, অ্যান্টিবায়োটিক দাও। মাথা নাড়েন খামারি—‘না, কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যাবে না।’
সেই ব্যাচের সাড়ে তিন হাজারের মধ্যে আড়াই হাজার মুরগি বাঁচানো গেল না। পরের ব্যাচের দুই হাজারও একই পথের যাত্রী হয়েছে। এমন তথ্য দিয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বড়ইতলী গ্রামের অর্গানিক চিকেন খামারের খামারি প্রকৌশলী ইমরুল হাসান বলেন, ‘আমার তত দিনে জেদ চেপে গেছে। অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া কি মুরগি বড় করা যাবে না।’
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদকে সঙ্গে নিয়ে আমরা দেখতে গিয়েছি ইমরুল হাসানের পোলট্রি খামার। ইমরুল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন। ২০০৩ সালে বুয়েট থেকে পাস করার পর দীর্ঘদিন দেশে ও বিদেশে টেলিকম ও তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। পেশাগত কারণে দীর্ঘদিন লন্ডন, মিসর, ফিলিপাইন, আরব আমিরাতে অবস্থান করার পর ২০১৪ সালের শেষের দিকে দেশে ফেরেন। এরপর তথ্যপ্রযুক্তি, পর্যটন ও কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করেন।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে শীতকালে ইমরুলের মুরগির খামারের যাত্রা শুরু। অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া মুরগি পালনের শুরুটা ভালো ছিল। প্রথম দুটি ব্যাচে কোনো ঝামেলা হয়নি, কারণ, সময়টা শীতের। তবে গরম আসার পরই হোঁচট খেতে হলো। পরপর দুবারই অধিকাংশ মুরগি মারা গেল। কর্মীরা ইমরুলকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের পরামর্শ দেন। ইমরুল শুধু মাথা নাড়েন।
অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া মুরগি পালনের নিশ্চয়ই কোনো উপায় আছে—পথ খুঁজতে থাকেন ইমরুল। একসময় পেয়েও গেলেন। বললেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া মুরগি পালনের সহজ উপায় হলো বয়সভেদে শেডের তাপমাত্রা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখা।’ এটির সঙ্গে খাটালেন তাঁর প্রকৌশলবিদ্যা। নিজেই খামারের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করলেন সার্বক্ষণিক তাপমাত্রা মনিটরিংয়ের সেন্সর। বসালেন কুলিং প্যাড। আর নজর দিলেন মুরগির খাবারে।
আমেরিকান ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার ও ইউরোপিয়ান অর্গানিক গাইডলাইন অনুসারে অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত ও অর্গানিক মুরগি পালনের জন্য নিজেই মুরগির ফিড তৈরি করতে শুরু করলেন। গ্রোথ প্রমোটার, মিল বোন মিট ও হরমোন ছাড়া ফিড বানান নিজে। দানাদার খাবার তৈরির জন্য ডিজাইন করলেন মেশিন। চীন থেকে সেটি তৈরি করেও আনলেন। মুরগির নিয়মিত অ্যাপল সিডার ভিনেগার উইথ মাদার, প্রাকৃতিক বিটেইন, অরেগানু, শজনেপাতা, কাঁচা হলুদ, রসুন, আদা, বিভিন্ন ধরনের শাক, পেঁপেপাতা, নিমপাতা, কাঁচা মরিচ ইত্যাদি খেতে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট উপাদান রক্ষা করে নিজস্ব মেশিনে তৈরি হয় মুরগির জন্য দানাদার খাবার।
শুরুতে শুধু একটি শেড দিয়ে শুরু করলেও এখন তিনটি শেডে চলছে কার্যক্রম। ইমরুলের খামারে মূলত ফরাসি হার্বার্ড প্রজাতির মুরগি পালন করা হয়। এক দিন বয়সী বাচ্চা নিয়ে আসা হয় হ্যাচারি থেকে। তারপর এগুলোকে শেডে পালা হয় ৫৫ থেকে ৬০ দিন। এর মধ্যে এগুলোর ওজন হয় ১ কেজি ২০০ গ্রামের মতো।
তিন নম্বর শেডে পালা হয় ব্রয়লার। এখানেও ১ দিনের বাচ্চা এনে ৪০-৪৫ দিন রাখার পর ২ কেজির বেশি ওজন হলে বিক্রি করা হয়। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় হালাল উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে নিজস্ব ফ্রিজিং ভ্যানে করে ঢাকাতে সরাসরি গ্রাহকের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয় মুরগি।
শেডের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ, উন্নত মানের খাবার ও ভালো মানের টিকার কারণে অর্গানিক মুরগির মূল্য বাজারদরের চেয়ে বেশি হয়। ইমরুল বললেন, ‘এসবের কারণে ব্রয়লার মুরগিতে আমাদের সাধারণ খামারি থেকে ৮৮ শতাংশ এবং কালার বার্ডে ৬৮ শতাংশ খরচ বেশি হয়।’ বর্তমানে প্রতি কেজি জীবিত কালার বার্ড ৩৩৩ টাকা ও ব্রয়লার ২৫০ টাকাতে গ্রাহকের বাসায় ফ্রিতে ডেলিভারি করছেন ইমরুল।
প্রকৌশল পেশা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনামের সঙ্গে চাকরি, যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্বের সুযোগ—এসব ছেড়ে কেন মুরগি পালছেন? ইমরুলের উত্তর, ‘পড়াশোনা করে জেনেছি অ্যান্টিবায়োটিকের অধিক ব্যবহার মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দেয়। আবার মানুষের শরীরকে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী করে ফেলে। এতে প্রয়োজনের সময় অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজে লাগে না।’
আমাদের দেশে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার চল আছে। তার চেয়ে ভয়ানক হলো খাবার তালিকা। আমেরিকার ফুড ও ড্রাগ এজেন্সি জানাচ্ছে, মুরগিতে বেশি শক্তিশালী ও ভয়াবহ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এ জন্য তাদের কৃষি বিভাগ বলছে, কোনো মুরগিতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হলে সেই ডোজ শেষ হওয়ার কমপক্ষে ১০ দিন পর ওই মুরগি খাওয়া উচিত।
এমন তথ্য দিয়ে প্রকৌশলী ইমরুল বললেন, ‘আমাদের দেশে এই নিয়ম কঠোরভাবে মানা হয় কি না কে জানে। আমি ভাবলাম, তাহলে আমি কোনোরূপ অ্যান্টিবায়োটিকবিহীন আমিষ সরবরাহের মাধ্যমে নিরাপদ খাবারের জন্য কাজ করি। যেহেতু নতুন প্রজন্ম মাছের চেয়ে মাংস বেশি পছন্দ করে, তাই এই পোলট্রি খামার!’
পারিবারিক যে জায়গাতে অর্গানিক চিকেনের খামার, সেখানে আর জায়গা নেই। তাই কাছাকাছি আরও চার একর জায়গাতে খামার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছেন ইমরুল হাসান। ছয় মাসের মধ্যে বড় আকারের খামারটি চালু করা হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের আইওটি স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় জেআরসি বোর্ড ব্যবহার করে খামার ব্যবস্থাপনাকে স্বয়ংক্রিয় করার একটি কার্যক্রম অচিরেই শুরু করবেন বলে জানালেন।