তিন দশক আগের কথা। পড়াশোনা শেষ করে সবে বড় ভাইয়ের পোশাক কারখানায় কাজ নিলেন। কঠোর পরিশ্রমও করলেন। তারপরও ব্যাটে-বলে হচ্ছিল না। দিলেন ছেড়ে। তারপর পরিচিত বিদেশি এক কূটনৈতিকের পরামর্শে দিলেন বায়িং হাউস। পর পর তিনটি ক্রয়াদেশ পেলেন। তবে একটি ক্রয়াদেশের পণ্যও ঠিকঠাকমতো করতে পারলেন না। ক্রয়াদেশ বাতিল হলো। বিপুল লোকসান গুনলেন। ঋণে জর্জরিত হলেন। তারপরও আত্মবিশ্বাস হারালেন না। ঠিকই ঘুরে দাঁড়ালেন।
বলছিলাম অ্যাবা গ্রুপের চেয়ারম্যান সাজ্জাদুর রহমান মৃধার কথা। চেষ্টা আর কঠোর পরিশ্রমে আজকে তিনি দেশের একজন সফল উদ্যোক্তা। শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারকদের একজন। দেশের মধ্যে গড়ে তুলেছেন বিশ্বমানের পাঁচ-পাঁচটি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা। তার চেয়ে বড় কথা, পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে সবার চেয়ে এগিয়ে। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি বর্তমানে দেড় শ। আর পরিবেশবান্ধব কারখানার এই যে আন্দোলন, সেটি কিন্তু সাজ্জাদুর রহমান মৃধার হাত ধরেই শুরু হয়েছিল।
পরিবেশবান্ধব কারখানা ১৫০টি
লিড প্লাটিনাম : ৪৪
লিড গ্লোড : ৯৩
লিড সিলভার : ৯
সার্টফায়েড : ৪
লিড প্লাটিনাম কারখানা—ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও, জেনেসিস ওয়াশিং, কলম্বিয়া ওয়াশিং প্ল্যান্ট, ইউএইচএম লিমিটেড, প্লামি ফ্যাশন, জেনেসিস ফ্যাশনস, রেমি হোল্ডিংস, ইএমএস অ্যাপারেলস, ডিজাইনার ফ্যাশন, মিথিলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ, এনভয় টেক্সটাইল, তোসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ (ফেব্রিক ডিভিশন), কানিজ ফ্যাশনস, এসকিউ কোলবেন্স, এসকিউ সেলসিয়াস ২, এসকিউ বিরিকিনা, তারাসিমা অ্যাপারেলস, ইকোটেক্স, কিউট ড্রেস ইন্ডাস্ট্রিজ, এসকিউ সেন্ট্রাল, এআর জিনস প্রোডিউসার, গ্রিন টেক্সটাইল (ইউনিট–৩), আমান গ্রাফিকস অ্যান্ড ডিজাইন, পাইওনিয়ার ডেনিম, কেনপার্ক-২, দি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স (ওভেন অ্যান্ড ইউনিট–২), সাউথ ব্রিজ স্কয়ার, প্যাসিফিক ক্যাজুয়ালস, জিএমএস টেক্সটাইলস, ডেকো অ্যাকসেসরিজ, আগামী অ্যাকসেসরিজ, আনোয়ারা ফ্যাশনস, কারণী নিট কম্পোজিট, ডেবোনিয়ার হোমওয়্যার ইউনিট, ডেবোনিয়ার পেডিং ইউনিট, পিএন কম্পোজিট, কারুপণ্য রংপুর, ভারটেক্স ওয়্যার ড্রেস ওয়ার্ল্ড নিও ফ্যাশন, ক্রসলাইন ওভেন অ্যাপারেলস, সায়হাম নিট কম্পোজিট, গোল্ডেন স্টিচ ডিজাইন এবং স্নোটেক্স আউটারওয়্যার।
অনেকের অজান্তেই ২০১২ সালে বাংলাদেশে প্রথম সনদপ্রাপ্ত পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল সাজ্জাদুর রহমান মৃধার প্রতিষ্ঠান ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও। আশ্চর্যজনকভাবে সেটি গড়ে উঠেছিল অপ্রচলিত এলাকায়, ঈশ্বরদী ইপিজেডে। অপ্রচলিত বলছি এই কারণে, আমাদের অধিকাংশ পোশাক কারখানা চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশ এলাকায় গড়ে উঠেছে। সেই তুলনায় ঈশ্বরদী অনেক দূরে। তাতে বড় সমস্যাটি হচ্ছে শ্রমিক পাওয়া যাবে কি না। সবাই জানেন পোশাক হচ্ছে শ্রমনিবিড় শিল্পের জন্য শ্রমিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাজ্জাদুর রহমান মৃধা সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। দারুণভাবে সফলও হয়েছেন।
পরিবেশবান্ধব কারখানার করার ধারণা কোথা থেকে পেয়েছিলেন। কীভাবে নতুন ধারণার কারখানার গড়ে তুললেন। সেসব জানতে গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সাজ্জাদুর রহমান মৃধার সঙ্গে ঘণ্টা দেড়েকের একটা দুর্দান্ত আড্ডা হলো। সেখানেই তিনি তাঁর গল্পের ঝাপ্পি মেলে ধরলেন। বললেন, ব্যবসায়িক কাজে ২০১০ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে পরিবেশবান্ধব কারখানার ধারণা পান। সকালে পত্রিকায় দেখলেন দেশটিতে দ্বিতীয় পরিবেশবান্ধব কারখানা উদ্বোধন হচ্ছে। আর সেটি নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। তখন নিজের দেশে পরিবেশবান্ধব কারখানা করার ইচ্ছা জাগে তাঁর মনে। সময় নষ্ট না করে কাজে নেমে পড়লেন। একটি পরিবেশবান্ধব কারখানার কনসালট্যান্ট বা পরামর্শককে খুঁজে বের করলেন।
সাজ্জাদুর রহমান মৃধা শ্রীলঙ্কান সেই পরামর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ করে কারখানা পরিদর্শনের চেষ্টা করেন। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলেন না। তারপরও দমলেন না। কৌশলে কারখানাটি ঘুরে এলেন। দেশে ফিরেই কারখানার জন্য জায়গা খুঁজতে শুরু করলেন। তখন গ্যাসের সংকট প্রকট। নতুন সংযোগ পাওয়া খুব কঠিন। শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরদীর ইপিজেড কর্তৃপক্ষ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে সেখানেই কারখানা করার সিদ্ধান্ত নেন।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর আমি নারায়ণগঞ্জে প্লামি ফ্যাশনস নামে পরিবেশবান্ধব কারখানা করার উদ্যোগ নেই। তখনো আমার জানা ছিল না—ইতিমধ্যে ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও নামে একটি পরিবেশবান্ধব কারখানা চালু হয়েছে। ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও নির্মাণের যিনি পরামর্শক ছিলেন জয়নাথ নামে একজন শ্রীলঙ্কান ভদ্রলোক। ঘটনাচক্রে তিনি আমাদেরও পরামর্শক ছিলেন। তাঁর কাছেই প্রথম আমরা ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিওর কথা শুনতে পাই।
যা-ই হোক, ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও কারখানা নির্মাণের আগে শ্রমিক পাওয়া যাবে কি না সেই দুশ্চিন্তা থাকলেও পরে তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। বরং অদ্ভুত এক সমস্যা তৈরি হলো। সাজ্জাদুর রহমান মৃধা বললেন, ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি আবেদন এল। এমনকি অনৈতিক লেনদেনের অভিযোগ আসতে লাগল। তখন মানবসম্পদ ও প্রশাসন প্রধানকে চাকরিচ্যুত করে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় পুরোপুরি স্বচ্ছতা আনা হয়। বর্তমানে কারখানাটিতে কর্মরত শ্রমিক কমপক্ষে উচ্চমাধ্যমিক পাস। মাস্টার্স পাস করাও শ্রমিক রয়েছে।’
সাজ্জাদুর রহমান বললেন, দেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানা ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও। পুরো এলাকায় কারখানার কর্মীরা বিশেষ সম্মান পান। মুদি থেকে শুরু করে সেলুন পর্যন্ত কোনো দোকানে সেবা নিতে গেলেও অগ্রাধিকার পান।
তৈরি পোশাক রপ্তানি
২০১৮-১৯ অর্থবছর ৩,৪১৩ কোটি ডলার
২০১৯-২০ ২,৭৯৪
২০২০-২১ ৩,১৪৫
প্রধান পাঁচ রপ্তানি হওয়া পোশাক (কোটি ডলারে)
ট্রাউজার টি-শার্ট সোয়েটার শার্ট অন্তর্বাস
২০১৮-১৯ ১১৭৫ ৭৯০ ৪২৫ ৩১৯ ১৬৪
২০১৯-২০ ৯৩৬ ৬২৭ ৩৫৯ ২৪৪ ১৩৫
২০২০-২১ ১,০৬৮ ৭২৩ ৪০৫ ২০৪ ১৭৮
পোশাকের বড় বাজার (কোটি ডলারে)
২০১৮-১৯ ২০১৯-২০ ২০২০-২১
যুক্তরাষ্ট্র ৬১৩ ৫১৪ ৫৯৪
ইইউ ২,১১৩ ১,৭১৪ ১,৯৪৩
কানাডা ১১৭ ৮৭ ৯৯
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) লিড প্লাটিনাম সনদ পাওয়া ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও ছিল সাজ্জাদুর রহমান মৃধার সপ্তম কারখানা। তবে বর্তমানে তাঁর কারখানার সংখ্যা ৫। গাজীপুরের মাওনায় বাকি চারটি কারখানাই ইউএসজিবিসির লিড গোল্ড সনদ পাওয়া। সব মিলিয়ে সাজ্জাদুর রহমান মৃধার অ্যাবা গ্রুপে কর্মীর সংখ্যা বর্তমানে সাড়ে ১২ হাজার। তাদের বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ২ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকার কাছাকাছি।
কেবল নিজের ব্যবসার লাভের দিকটা না দেখে পুরো শিল্পের চেহারা পরিবর্তনে যাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন তাঁদের মধ্যে সাজ্জাদুর রহমানও রয়েছেন। নিজে পরিবেশবান্ধব কারখানা করে চুপচাপ বসে থাকেননি। বললেন, অন্যদের পরিবেশবান্ধর কারখানা নির্মাণে উৎসাহ দিয়েছেন। ২২-২৩টি পরিবেশবান্ধব কারখানার নকশা বিনা খরচায় করে দিয়েছেন তিনি।
পরিবেশবান্ধব কারখানা করেই থেমে নেই সাজ্জাদুর রহমান মৃধা। তিনি ডেনিমের ওয়াশিং নিয়েও গবেষণা করছেন। বললেন, ডেনিমের ওয়াশিংয়ের প্রচুর পানি খরচ হয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে আনুপাতিক হারে রাসায়নিকও খরচ হয়। এই পানি ও রাসায়নিক ব্যয় কমিয়ে আনার নতুন বিষয় উদ্ভাবনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। বর্তমানে ওয়াশিংয়ে যে পানি ব্যবহার করা হয়, সেটি ৭০ শতাংশ কমিয়ে আনার পাশাপাশি রাসায়নিক সাশ্রয় হবে।
রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল। সেখান থেকে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার জন্য ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের ভূমিকা রয়েছে। উদ্যোক্তাদেরও চেষ্টার কমতি ছিল না। পাশাপাশি ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিওর এই নীর বিপ্লবের পর একে একে প্লামি ফ্যাশনস, রেমি হোল্ডিংস, এনভয় টেক্সটাইলস মতো পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মিত হয়। ধীরে ধীরে পরিবেশবান্ধব কারখানার আন্দোলন বেগবান হয়েছে। সেই ধারবাহিকতায় আগামী বছর দুয়েকের মধ্যে পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা দুই শ-আড়াই শ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের পর সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানা আছে শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়ায়। তবে সেসব দেশে পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা খুব বেশি না। বাংলাদেশ এখন পরিবেশবান্ধব কারখানার দেশ। এই স্লোগানটা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিষ্ঠিত করে বাংলাদেশের ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং করা সম্ভব। তাতে শ্রমিকদের পাশাপাশি শিল্প ও দেশ উপকৃত হবে।
আমি আশায় আছি, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একদিন বাংলাদেশের পোশাক খাতের নাম উচ্চারিত হবে এভাবে—বাংলাদেশ ইজ আ ল্যান্ড অব গ্রিন ফ্যাক্টরি। আমার মনে হয়, সেই দিন আর খুব বেশি দূরে নয়...।
ফজলুল হক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্লামি ফ্যাশনস এবং সাবেক সভাপতি, নিট পোশাকশিল্প প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ)