স্মৃতিচারণা

পদত্যাগ করতে সারা রাত অপেক্ষায় ছিলেন এ এম এ মুহিত

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও তাঁর মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড কাছে থেকে প্রায় ১০ বছর অনুসরণ করা হয়েছে। এ সময় নেওয়া সাক্ষাৎকার ও স্মৃতি থেকে উপলব্ধি করা যায়, মুহিত ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান মানুষ।

আবুল মাল আবদুল মুহিত
ফাইল ছবি

সদ্য প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন প্রাজ্ঞজন ও স্পষ্টভাষী। ছিলেন দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখেছি, সঠিক প্রশ্ন করলে তিনি জবাব দিতেনই। কখনোই প্রশ্ন এড়ানোর চেষ্টা করতেন না। সাংবাদিকদের পছন্দ করতেন। বলতেন, ‘তোমরা আমার নিজের লোক।’ তবে কেউ অপরিপক্ব, ভুল বা অপরিণত প্রশ্ন করলে ‘রাবিশ, বোগাস’ বলে খেপে যেতেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় ২০০৯ সালের ১২ জানুয়ারি আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে আমার প্রথম কথা বলার সুযোগ হয়। দায়িত্ব পেয়ে তাঁর মন্ত্রণালয়ের সব বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি তখন একের পর এক বৈঠক করে যাচ্ছিলেন। সেদিনের বৈঠকটি ছিল অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে ইআরডি কার্যালয়ে তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া জনাব মুহিতের সামনে বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণসহ ইআরডির সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছিলেন।

সাদামাটা ও সহজ-সরল জীবনের অধিকারী আবদুল মুহিতকে সাহস করে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনি একসময় গুরুত্বপূর্ণ আমলা ছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে আছেন অনেক বছর। কোনো কাজ আদায় করে নিতে আপনাকে কেউ ঘুষ দিতে চায়নি?’ জনাব মুহিত হেসেছিলেন অনেকক্ষণ।

আবদুল মুহিত সেদিন বলেছিলেন, ‘৩০ বছর আগের বৈদেশিক সাহায্যনির্ভরতা কাটিয়ে উঠছে বাংলাদেশ। বৈদেশিক সাহায্যনির্ভরতার হার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ শতাংশের নিচে। এর অর্থ হচ্ছে আমরা আত্মনির্ভরশীলতার দিকে এগোচ্ছি।’ দেশের সরকারি অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা যে দুর্বল, সে কথাও সেদিন বলেছিলেন তিনি।

সেদিন থেকে টানা ১০ বছর, যত দিন তিনি মন্ত্রী ছিলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত প্রধান প্রধান সংবাদ ব্রিফিংয়ে রিপোর্টার হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। বিভিন্ন সংস্থা ও সমিতির সঙ্গে প্রাক্‌-বাজেট আলোচনা; বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক, আর্থিক খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেওয়া, সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে ব্রিফিং ইত্যাদি ছিল তাঁর সঙ্গে কথা বলার বা তাঁকে প্রশ্ন করার সুযোগ। তিনি গল্প বলা শুরু করলে আর থামতে চাইতেন না। পুরোনো দিনের স্মৃতি, দিন–তারিখসহ বলতে পারতেন।

অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের ১০ বছরে পাঁচটি এবং তার পরের চার বছরে দুটি অর্থাৎ সাতটি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে গত ২১ মার্চ তিনি কেমন আছেন জানতে গিয়েও তাঁকে অনেক প্রশ্ন করা হয়। তিনি সাবলীলভাবেই সব জবাব দিয়েছিলেন। বাজেটের আগে সাক্ষাৎকার চাইলে ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দিতেন।

রিজার্ভ চুরির পরপর প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান ও আমি আবদুল মুহিতের লম্বা একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, রিজার্ভ চুরির পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত। এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি একটি ব্যাখ্যা দিয়ে জানিয়েছিলেন, সাক্ষাৎকারের বক্তব৵কে তিনি গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। সাক্ষাৎকারটি রেকর্ড করা ছিল।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের দুটি অনুষ্ঠান হয় প্রতিবছর। একটি বসন্তকালীন বৈঠক, আরেকটি বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম)। ২০১৫ সালে বসন্তকালীন ও ২০১৭ সালে এজিএমে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। দুবার দুটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয় ‘কৃষি ব্যাংকের ওপর আমি খুবই অসন্তুষ্ট।’

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ছিল সংসদ নির্বাচন। তার আগে ওয়াশিংটনে নেওয়া ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল, ‘আমাদের অনেক এমপির পাস করতে বেগ পেতে হবে।’ এ নিয়ে মন্ত্রিসভায় তাঁকে কটাক্ষ করা হয় বলে মন্ত্রিসভায় উপস্থিত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে পরে জানা গেছে। জনাব মুহিত পরে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি যা বলেছি, ঠিকই বলেছি।’

দেশ নিয়ে জনাব মুহিত ছিলেন সব সময়ই উচ্চাভিলাষী। দায়িত্ব নিয়েই তিনি বাজেটকে এক লাখ কোটি টাকার ওপরে নিয়ে যান। আর দায়িত্ব শেষ করার সময় এ বাজেট ছিল চার লাখ কোটি টাকার বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ে সব সময় সাংবাদিকেরা থাকতেন। একদিন একা পেয়ে আমার সঙ্গে প্রায় আধা ঘণ্টা কথা বললেন, যার বিষয়বস্তু ছিল সাংবাদিকতা। ২০১৭ সালের বাজেট ঘোষণার পরের ঘটনা। তিন বলেছিলেন, গঠনমূলক সমালোচনা সব সময় তাঁর পছন্দ এবং প্রথম আলো বেশির ভাগ সময়ই তা করে। কোনো কোনো বিষয়ে নিজের মত বজায় রাখতে না পেরে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছাড়তে ১০ বছরে তিনবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই প্রতিবেদককে সেদিন বললেন, ‘একদিন সারা রাত ঘুমাইনি, কখন সকাল হবে আর আমি পদত্যাগ করতে যাব সেই অপেক্ষায়। প্রধানমন্ত্রীর কারণে পরে কোনোবারই পদত্যাগ করা হয়নি।’

বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু, সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর, রাজনৈতিক কারণে ব্যাংক ও বিমার নতুন লাইসেন্স দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন করলে তাঁর কাছ থেকে জবাব পাওয়া যেতই।

তাঁকেও ঘুষ সাধা হয়েছিল

সাদামাটা ও সহজ-সরল জীবনের অধিকারী আবদুল মুহিতকে সাহস করে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনি একসময় গুরুত্বপূর্ণ আমলা ছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে আছেন অনেক বছর। কোনো কাজ আদায় করে নিতে আপনাকে কেউ ঘুষ দিতে চায়নি?’

জনাব মুহিত হেসেছিলেন অনেকক্ষণ। বললেন, ‘১৯৬২ সালের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন দপ্তরের তিন কোটি টাকার একটা কাজ। আল ফারুক নামের একটা কোম্পানি ছিল। টাকাটা যখন ওই কোম্পানিকে বরাদ্দ দিতে যাচ্ছি, তখন জাপানি একটা পার্টির লোক এলেন। কাজটির ব্যাপারে জাপানি পার্টির সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম। জাপানি পার্টির লোক এসে আমাদের কমিটির চেয়ারম্যান জনাব রশিদকে একটা স্লিপ দিলেন যে তুমি যদি কাজটা দাও, তোমাদের জন্য ভালো একটা ভাগ থাকবে। আমি যেহেতু কমিটির সদস্য, সে হিসেবে আমারও ভাগের প্রশ্ন রয়েছে এতে। এটা হচ্ছে সরাসরি অফার।’

আরও কোনো ঘটনা আছে কি না, জানতে চাইলে বলেছিলেন, ‘আরেকটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা আছে আমার এক সাবেক বসের সঙ্গে। সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন তিনি এবং তিনিও আমাকে ঘুষ সেধেছিলেন। ১৯৬৭ সাল। তিনি কিছু পণ্য আমদানি করতে চেয়েছিলেন স্কটল্যান্ড থেকে। কিন্তু আমরা তাঁকে অনুমতি দিচ্ছিলাম না। কাজটির ব্যাপারে দুইটা পার্টি ছিল তখন। একটা আইয়ুব খান বলয়ের, আরেকটা ইয়াহিয়া খান বলয়ের। তিনি একটা বলয়ে ছিলেন। তিনি এসে আমাকে বললেন, তুমি যদি কাজটা করে দাও, তাহলে তোমার ভাইকে একটা কাজ দেব। তারপর এ ধরনের ঘুষ কেউ সাধতে আসেনি।’

দুর্নীতি কমানো নিয়ে যা ভাবতেন

এক দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দিয়ে দুর্নীতি কমানো যাবে না বলে মনে করতেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। বলতেন, এ দুর্নীতি কমাতে লাগবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার। দুর্নীতি কমানোর একটা ভালো সহায়ক শক্তি তথ্যপ্রযুক্তি। সুযোগ পেলেই একটি উদাহরণ দিতেন। ‘আমি সিলেটের মদনমোহন কলেজের উদাহরণটি সামনে আনতে পারি। কলেজটার আয় দেখানো হতো বছরে ৮ লাখ টাকা। অনলাইন পদ্ধতি চালুর পর আয় বেড়ে দাঁড়াল ৮১ লাখ টাকা।’

ব্যাংক খাতের দুরবস্থা নিয়ে সরাসরি কথা বলতে দ্বিধা করতেন না। এক সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘এ খাত ভালো চলছে না। একশ্রেণির লোক ব্যাপক লুটপাট করছে। আমাদের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে সরকারি ব্যাংক। কিছু কিছু লুটপাট বেসরকারি ব্যাংকেও দেখা যাচ্ছে। সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হারটা খুব বেশি। কারণও আছে। সরকারি ব্যাংকগুলো কিছু অর্থায়ন করে সরকারের অনুরোধে বা দিকনির্দেশনায়। এগুলোর আদায় পরিস্থিতি খারাপ।’

মুহিত বলেছিলেন, সরকারি ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ কম। বেশি নিয়ন্ত্রণ সরকারের। সরকারের নিয়ন্ত্রণ অবশ্য কমানোর চিন্তা ছিল তাঁর। পুরো দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দিলে কিছু ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হবে বলেও আশঙ্কা করতেন। আর অকপটে স্বীকার করতেন, খেলাপি সংস্কৃতির ব্যাপারে তেমন কিছুই করা হয়ে ওঠেনি তাঁর।

উপভোগ করতেন নিজের জন্মদিন

২০১৪ সালে মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনের সামনে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পরিবারের সদস্য ও মন্ত্রণালয়ের সহকর্মীদের নিয়ে ৮১তম জন্মদিন উদ্‌যাপন করেছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। স্ত্রী সৈয়দ সাবিয়া মুহিত, বড় ছেলে সাহেদ মুহিত ও তাঁর স্ত্রী এবং একমাত্র মেয়ে সামিনা মুহিতকে সঙ্গে নিয়ে এ অনুষ্ঠান। অফিসের কাজ শেষে দেখা হতেই আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি অবশ্যই আসবে।’
সন্ধ্যার পর গিয়ে দেখি ফুচকা, চটপটি ও গরম জিলাপির আয়োজনে ভরা অনুষ্ঠান।

বাগানের সামনে খোলা জায়গায় প্যান্ডেল। স্ত্রী ও পুত্রবধূর সহযোগিতা নিয়ে কেক কাটলেন মুহিত। কেক কাটার আগে ছোট্ট একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আপনাদের দোয়া ও আল্লাহর রহমতে আজ আমি ৮১-তে পা দিয়েছি এবং সুস্থ আছি। আমার ছোট ছেলেটি বিদেশে। তাই উপস্থিত নেই। তবে সে মানসিকভাবে এই অনুষ্ঠানে আছে।’ বলছিলেন, ‘কেউ কিছু খাচ্ছেন না কেন।’ তিনি নিজেও মিষ্টিসহ সব ধরনের খাবার খেতে পছন্দ করতেন। গর্ব করে বলতেন, ‘আমার পরিবারের কারও ডায়াবেটিস নেই।’
অনুষ্ঠানের একফাঁকে জানতে চাইলে বলেছিলেন, ‘জন্মদিনটা আমি সব সময়ই পালন করি। এদিন আমি খুব মজা করি, সেই ছোট্টবেলা থেকেই।’ এ বছরের ২৫ জানুয়ারিও ফরেন সার্ভিস একাডেমি প্রাঙ্গণে ৮৮তম জন্মদিন উদ্‌যাপিত হয় চ্যানেল আইয়ের আয়োজনে। সেদিন আবদুল মুহিত সবার উদ্দেশে বলেন, ‘আজকের দিনে আমি কোনো উপদেশ দিতে চাই না। দেশ ও দশের মঙ্গলচিন্তা করলে তাঁদের জন্য ভালো কিছু করা যায়। আমি সারা জীবন সেটাই করে এসেছি।’

আবুল মাল আবদুল মুহিতের অন্যতম গুণ ছিল তাঁর কাছে কোনো ফাইল এলে পুরোটা পড়তেন এবং মার্জিনে মন্তব্য করতেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রায় সব পর্যায়ের কর্মকর্তার কাছ থেকে এ রকম মন্তব্য দেখার সুযোগ হয়েছে এই প্রতিবেদকের। এমনকি দৈনিক পত্রিকার কাটিংয়েও মন্তব্য করতেন তিনি, যা প্রায় বিরল বলেই মনে হয়।