সাভারের চামড়াশিল্প নগরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) বাইরে নিজস্ব বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) তৈরি করবে দুই ট্যানারি অ্যাপেক্স ও বে। অবশেষে তাদের অনুমতি দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সূত্রে জানা যায়, ২৩ জুলাই ট্যানারি দুটিকে আলাদা ইটিপি করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। চামড়া শিল্পনগর কার্যালয়ের এ–সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, দুই ট্যানারিকে নিজস্ব অর্থায়নে ইটিপি করার অনুমতি দেওয়া হলো। তবে শর্ত হলো, ট্যানারি দুটিতে হাইকোর্টের শর্ত, চামড়া শিল্পনগর নিয়ে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি ও পরিবেশগত মান রক্ষা করতে হবে।
জানতে চাইলে বে গ্রুপের চেয়ারম্যান শামসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অনুমোদন পেয়েছি। এবার আমরা আন্তর্জাতিক সংগঠন লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পাওয়ার উপযোগী একটি ইটিপির কাজ শুরু করব। ইটিপি তৈরি আর এলডব্লিউজির সনদ পেতে দুই বছরের মতো সময় রাগবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যখন আবেদন করেছিলাম, তখন অনুমোদনটি দিয়ে দিলে এত দিনে কাজ শেষ হয়ে যেত।’
কথা ছিল, সাভারের চামড়া শিল্পনগরের ১৫৫টি ট্যানারির জন্য ১টি কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার হবে। পাইপলাইন দিয়ে সব ট্যানারির বর্জ্য ওই সিইটিপিতে যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো, চীনা প্রতিষ্ঠান জেএলইপিসিএ-ডিসিএল জেভিকে ২০১২ সালের ১১ মার্চ সিইটিপি নির্মাণের কার্যাদেশ দিয়ে আজও তা শেষ করতে পারেনি বিসিক। সাভারে ২০০ একর জমিতে চামড়াশিল্প নগর প্রতিষ্ঠার জন্য বিসিক ২০০৩ সালে প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকার মধ্যে ৬৪২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা রাখা হয়েছে সিইটিপি ও অন্যান্য বর্জ্য পরিশোধনব্যবস্থা নির্মাণের জন্য।
হতাশার দিক হলো, দেড় বছরের মধ্যে সিইটিপি নির্মাণ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু পেরিয়ে গেছে আট বছর। সিইটিপি খুব সহজে যে এলডব্লিউজি সনদ পাবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে রপ্তানিমুখী ট্যানারিমালিকদের। এ কারণেই অ্যাপেক্স ও বে সরকারের কাছে আলাদা ইটিপি করার অনুমোদন চায়, যাতে তারা নিজেরা এলডব্লিউজি সনদ পেতে পারে।
এলডব্লিউজি সনদধারী ট্যানারির কাছ থেকে কেনা চামড়ায় তৈরি পণ্য বড় ব্র্যান্ডের কাছে রপ্তানি করা যায়। লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সংগঠনটির সদস্য বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের সংখ্যা ৯৫টি।
বাংলাদেশে তিনটি ট্যানারির এলডব্লিউজি সনদ রয়েছে। দেশে প্রথম এলডব্লিউজি সনদ পায় অ্যাপেক্স ফ্যুটওয়ারের ট্যানারি ইউনিট, ২০১৫ সালে। তারা নিরীক্ষায় সেরা মান, অর্থাৎ গোল্ড কারখানার মর্যাদা অর্জন করে।
অ্যাপেক্স চামড়া প্রক্রিয়াকরণের দ্বিতীয় ধাপ ‘ক্রাস্ট’ ও তৃতীয় ধাপ ‘ফিনিশড’ পর্যায়ে কাজ করে, ওয়েট ব্লু নয়। গত বছর অস্টন লিমিটেড নামেঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের একটি ট্যানারি এলডব্লিউজি সনদ পায়। অবশ্য এ ট্যানারিটিও ওয়েট ব্লু পর্যায়ে কাজ করে না। ওয়েট ব্লু পর্যায়ে এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া একমাত্র ট্যানারি চট্টগ্রামের রিফ লেদার, যারা সম্প্রতি সনদটি পেয়েছে।
বিশ্বে এলডব্লিউজির সনদপ্রাপ্ত চামড়া উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৪৩টি। এর মধ্যে পাশের দেশ ভারতে ১৩৯, চীনে ১০৩, ইতালিতে ৬৮, ব্রাজিলে ৬০, তাইওয়ানে ২৪, স্পেনে ১৭, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কে ১৬ ও ভিয়েতনামে ১৪টি উৎপাদনকারী রয়েছে।
>অবশেষে অ্যাপেক্স ও বে ট্যানারিকে নিজস্ব ইটিপি করার অনুমতি দিল শিল্প মন্ত্রণালয়
নিজস্ব ইটিপি করার অনুমতি চেয়ে অ্যাপেক্স ও বে ২০১৭ সালে আবেদন করে। তবে সেটির বিরোধী ছিলেন অন্যান্য ট্যানারিমালিকেরা। তাঁদের আশঙ্কা, অ্যাপেক্স ও বে আলাদা ইটিপি করলে সিইটিপির পরিচালনা ব্যয় তাঁরা পোষাতে পারবেন না। বিসিকও এ কারণ দেখিয়ে অনুমতি দিতে উদ্যোগী হয়নি।
অ্যাপেক্স ট্যানারির নির্বাহী পরিচালক এম এ মাজেদ বলেন, ‘আমরা বলেছি, আমাদের বর্জ্য নিজেরা পরিশোধন করলেও সিইটিপির খরচ দেব। তারপরও আমরা নিজেরা ইটিপি করতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সংকটে রয়েছি। এখন খরচ বেশি হলেও কিছু করার নেই।’
বে ট্যানারি সাভারের চামড়া শিল্পনগরে তাইওয়ানের টেচ্যাং লেদারের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ করেছিল। বিশ্বব্যাপী চামড়ার বড় সরবরাহকারীদের একটি টেচ্যাং। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও সিইটিপি কার্যকর না হওয়ায় কোম্পানিটি বাংলাদেশ ছাড়ে। এখন নিজেদের বিনিয়োগ বাঁচাতে বাড়তি খরচ হলেও আলাদা ইটিপি করতে মরিয়া বে।
বে গ্রুপের চেয়ারম্যান শামসুর রহমান বলেন, ‘আমরা এলডব্লিউজির শর্ত মেনে ইটিপি করব। এটি করতে পারলে যেকোনো মান রক্ষা করা সম্ভব হবে।’