এসএনভি বাংলাদেশের ওয়ার্কিং উইথ ওমেন প্রকল্প-২ এবং প্রথম আলোর যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো ভার্চ্যুয়াল আলোচনা।
পোশাকশিল্প খাতকে টেকসই ও উৎপাদনক্ষম করে টিকিয়ে রাখতে করোনাকালে নারী পোশাককর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এই কর্মীদের প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ নারী শ্রমিক। তাই কারখানায় উৎপাদনের গতি ধরে রাখতে হলে নারী কর্মীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসহ শারীরিক-মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন সরকারি কর্মকর্তা, উন্নয়ন সংস্থা, পোশাকশিল্পের মালিক ও চিকিৎসকেরা।
তাঁদের মতে, সব সময়, বিশেষ করে করোনাকালে দেশের প্রধান রপ্তানি খাতকে রক্ষায় মালিক-কর্মী দুই পক্ষকেই কারখানার ভেতরে-বাইরে স্বাস্থ্যসচেতন হতে হবে। কর্মীরা সুস্থ না থাকলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। বৃহস্পতিবার এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় এসব মত প্রকাশ করেন তাঁরা।
নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত এসএনভি বাংলাদেশের ওয়ার্কিং উইথ ওমেন প্রকল্প-২ এবং প্রথম আলোর যৌথ উদ্যোগে ‘পোশাকশিল্পে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা’ শিরোনামের আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। ছয় পর্বের এ সভার প্রথম পর্বে অংশ নেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু) মোহাম্মদ শরীফ, পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক নজরুল ইসলাম, এসএনভির আরএমজি ইনক্লুসিভ বিজনেস প্রোগ্রামের টিম লিডার ফারথিবা রাহাত খান এবং আল হেরা হাসপাতালের চিকিৎসক মো. আবুল হোসেন। সভাটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
এসএনভি জানিয়েছে, দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে মূল অবদান রাখছে পোশাকশিল্প খাত। দেশের প্রধান রপ্তানি খাতও এটি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট রপ্তানির ৮৩ শতাংশ ছিল পোশাকশিল্প খাতের। ৪ হাজার ৬২১ পোশাক কারখানায় কাজ করছেন প্রায় ৪২ লাখ কর্মী এবং এর মধ্যে দুই–তৃতীয়াংশ নারী শ্রমিক রয়েছেন। এই নারীরা পরোক্ষভাবে সহায়তা করছেন প্রায় ২৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে। তাই এ খাতের নারীদের সুরক্ষায় মালিকপক্ষের পাশাপাশি সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে।
ফারথিবা রাহাত খান জানান, পোশাক কারখানার নারী কর্মীরা অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখে চলেছেন। তাই এ খাতকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন পোশাক কারখানায় প্রশিক্ষণ দিয়ে মালিক, ক্রেতা ও কর্মীদের সচেতন করে তোলার কাজ করছেন তাঁরা। যেসব পোশাক কারখানায় নারী কর্মীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য এবং নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, সেসব কারখানায় পরিবর্তন এসেছে। তবে এমন কারখানার সংখ্যা কম। অধিকাংশ কর্মী নারী হলেও অনেক কারখানায় চিকিৎসক নারী নন। আবার চিকিৎসক প্রতিদিন থাকেন না। কর্মঘণ্টার মধ্যে কর্মীরা যেন প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসাসেবা পান, সে লক্ষ্যে সরকারি ব্যবস্থা থাকলে কর্মীদের সুবিধা হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ শরীফ বলেন, পোশাকশিল্প কারখানার নারী কর্মীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ওপর জোর দিয়ে সরকার ৩৫৪টি কারখানায় বিনা মূল্যে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী—বড়ি, কনডম দিচ্ছে। পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা ইনজেকশন সেবাও দিচ্ছে। সরকার প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সব পোশাক কারখানায় কাজ করবে। তবে মালিকপক্ষকেও সচেতন হতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন পোশাক কারখানা পরিদর্শন করে দেখা গেছে, কোথাও কোথাও কর্মীদের প্রজননসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় চমৎকার ব্যবস্থা নেওয়া আছে। কোথাও কোথাও একেবারে নেই।
বিজিএমইএর পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, বিজিএমইএ কারখানাগুলোকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে ১২টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তুলেছে। সেখানে চিকিৎসক ও প্যারামেডিকরা সেবা দিয়ে থাকেন। কর্মীদের জন্য চট্টগ্রামে পূর্ণাঙ্গ একটি হাসপাতাল রয়েছে। ঢাকার মিরপুরে আরেকটি হাসপাতাল নির্মাণের কাজ চলমান। করোনাকালে কারখানাগুলোতে কর্মীদের স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে কর্মীদের স্বাস্থ্যগত বিষয়ে সচেতন করা হয়।
এসএনভি যেসব কারখানায় প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করে সেসব কারখানার নারী কর্মীরা স্বল্প মূল্যের বিমাসুবিধার আওতায় কারখানার কাছাকাছি অবস্থিত মানসম্মত হাসপাতালগুলো থেকে চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন। যার মধ্যে আল হেরা হাসপাতাল একটি। হাসপাতালের চিকিৎসক মো. আবুল হোসেন বলেন, সচেতনতা যেভাবে বাড়ানো প্রয়োজন, সেভাবে কাজ করা হয় না। পোশাককর্মীদের খুবই ব্যস্ততার মধ্যে দিন যায়। সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বলতে যা বোঝায়, তা তাঁরা পাচ্ছেন না। বেশির ভাগই খুব অসুস্থ হয়ে না পড়া পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে আসতে চান না।
এসএনভি জানিয়েছে, রানা প্লাজা ধসের পর কর্মস্থলে নিরাপত্তা, শ্রমমান, পরিবেশগত টেকসই ব্যবস্থা ইত্যাদির ওপর জোর দিয়ে পোশাকশিল্প কারখানাগুলোকে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপরও কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না।
মোহাম্মদ শরীফ এ ব্যাপারে বলেন, কোভিড-১৯ মানুষকে শিক্ষা দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের বোধোদয় হয়েছে, তাঁদের সুরক্ষিত রাখতে হবে, তাঁদের কাজ যাঁরা করছেন, তাঁদের সুরক্ষাও দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে পারে।
করোনাকালে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিতে জোর দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, কর্মী সুস্থ না থাকলে রপ্তানি আদেশ নেওয়া নিরর্থক, যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ করা যাবে না। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে বিজিএমইএ একত্রে কাজ করতে চায় যাতে এ খাত টেকসই ও দৃষ্টান্তমূলক হয়। কর্মীদের খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টিও জরুরি। এর আগে বিজিএমইএ, কর্মীদের জন্য রেশনিং চালু করেছিল। সরকার সুযোগ দিলে আবারও এ ব্যবস্থা চালু করা যাবে।
সঞ্চালকের ভূমিকায় আব্দুল কাইয়ুম বলেন, এ খাতের প্রাণ নারী কর্মীরা। তাই এই কর্মীদের সুস্বাস্থ্য, পুষ্টি নিশ্চিত করা না গেলে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হবে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে তাঁদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে ডিম, দুধ, কলাসহ পুষ্টিকর খাবার কারখানার পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা যেতে পারে। পাশাপাশি কাজ চলাকালে কোনো এক ফাঁকে কর্মীদের শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত ব্যায়ামের জন্য অন্তত ৫-১০ মিনিট সময় দেওয়া যেতে পারে। করোনাকালে সুস্থ থাকার জন্য এই ব্যায়াম খুব জরুরি।