ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো যে বছর (২০১৭) সাভারের হেমায়েতপুরে গেল, সেই বছর থেকে ধলেশ্বরী নদীর পানি দিয়ে ভাত রান্না বন্ধ করেছে হজরত আলীর পরিবার।
চামড়াশিল্প নগরের ঠিক উল্টো পাশে, নদীর ওপারে লংকারচরে হজরত আলীর বাড়ি। নদীটির আনুষ্ঠানিক নাম ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা না বংশী, তা ঠিক বলতে পারলেন না মধ্যবয়সী ওই ব্যক্তি (৫২)। তবে এই নদীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় শৈশব থেকে। এই নদীতে সাঁতরে তিনি বড় হয়েছেন। এই নদীর মাছই তাঁর শরীরে পুষ্টি জুগিয়েছে।
হজরত আলী বললেন, এখন শুধু বর্ষার কয়েক মাস নদীটিতে নামা যায়। শীতে নামলেই গা চুলকায়। এমনকি গরুকে গোসলও করাতে হয় টিউবওয়েলের পানি দিয়ে। প্রায়ই মাছ মরে ওঠে। সবকিছুর কারণ ট্যানারির বর্জ্য।
চামড়াশিল্প নগরের পাশে জমজম আবাসিক এলাকার খেয়াঘাটে হজরত আলী তাঁর ভাই শুক্কুর আলীকে নিয়ে খেয়া পারাপারের অপেক্ষায় ছিলেন। খেয়াঘাটে জটলা তৈরি হলো। স্থানীয়রা দিলেন ট্যানারির বর্জ্যে নদীদূষণের ফিরিস্তি। নজরুল ইসলাম বললেন, ‘শীতকালে এলে দেখতে পাবেন নদীর অবস্থা আসলে কী! কেমিক্যালে নদীটি মরে যাচ্ছে।’
অথচ নদী বাঁচাতেই (বুড়িগঙ্গা) ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারের হেমায়েতপুরে নেওয়ার জন্য ধলেশ্বরী নদীর তীরে ১৯৯ একর জমিতে চামড়াশিল্প নগর তৈরি হয়েছিল। কথা ছিল, ট্যানারিগুলো পরিকল্পিত শিল্পনগরে এলে বুড়িগঙ্গা দূষণ থেকে বাঁচবে। আর পরিবেশ দূষণে অপবাদ ঘুচিয়ে চামড়া হবে ‘কমপ্লায়েন্ট’। বড় ব্র্যান্ডগুলোর আর বাংলাদেশি চামড়ায় তৈরি জুতা-ব্যাগ কিনতে কোনো দ্বিধা থাকবে না। চামড়া খাতে বিনিয়োগ বাড়বে, মানুষ কাজ পাবে।
এ লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালে চামড়াশিল্প নগর প্রকল্প নেয়। আজ ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে এসে চামড়া খাত ডোবার পথে। রপ্তানি আয় ব্যাপকভাবে কমেছে। শ্রমিকদের অনেকের জীবিকা বিপন্ন। বুড়িগঙ্গার পর ধলেশ্বরী দূষণের শিকার। মাঝখানে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ২০ কোটি টাকার মতো, যার সিংহভাগই জনগণের করের টাকা।
এই যে ২০০৩ সালে নেওয়া প্রকল্প এখনো হলো না, ১৮ মাসে যে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) কাজ শেষ হওয়ার কথা, তা আট বছরেও শেষ হয়নি, বর্জ্য ফেলার জায়গা (ডাম্পিং ইয়ার্ড) এখনো তৈরি হলো না, অথচ ট্যানারিগুলোকে সাভারে নিয়ে ধলেশ্বরী দূষণ করা হচ্ছে—এসবের দায় কার?
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ সরাসরি বললেন, পুরো দায় বিসিকের। তিনি বলেন, ঘন ঘন সংস্থাটির চেয়ারম্যান পাল্টেছে। প্রকল্প পরিচালক পাল্টেছে। এক পরিচালক আরেক পরিচালকের ওপর দায় চাপিয়ে পার পেয়েছেন। কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা যায়নি।
চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পের শুরুর বছর ২০০৩ সাল থেকে ২০২০; এই সময়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ে চারজন নিয়মিত মন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন। যাঁরা হলেন এম কে আনোয়ার, মতিউর রহমান নিজামী, দিলীপ বড়ুয়া ও আমির হোসেন আমু (নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বাদে)। এখন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন ও প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কামাল আহমেদ মজুমদার।
আলোচ্য সময়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ে সচিব বদলেছেন ১২ জন। নতুন করে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন কে এম আলী আজম, এই কিছুদিন আগে। চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনে (বিসিক) চেয়ারম্যান পাল্টেছেন ১৭ জন। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন মো. মোশতাক হাসান। চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পটিতে এখন পর্যন্ত ১৬ জন পরিচালক দায়িত্ব পালন করেছেন।
চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পে এখন পরিচালকের দায়িত্বে আছেন জিতেন্দ্রনাথ পাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৭ সালে অত তাড়াহুড়া করে ট্যানারিগুলোকে সাভারে না নিলেই মনে হয় ভালো হতো।’ তিনি প্রকল্পে বিলম্ব হওয়ার কিছু কারণ উল্লেখ করেন। বলেন, শুরুতে মামলার কারণে কাজ অনেক বছর আটকে ছিল। প্রকৃতপক্ষে কার্যাদেশ দেওয়া শুরু হয়েছে ২০১২ সাল থেকে। সিইটিপির সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ জুড়ে দেওয়ায় দেরি হয়েছে। তিনি মনে করেন, কাজ শেষ না করেই ট্যানারি সাভারে নিয়ে ফল পেতে যাওয়াও বিলম্বের একটি কারণ।
কাজ কী কী বাকি
চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পটি চার দফা সংশোধন করা হয়েছে। মেয়াদ বেড়েছে বহুবার। এখনো মূল ডাম্পিং ইয়ার্ডের কাজ শুরুই হয়নি। এর আগে অস্থায়ী তিনটি ডাম্পিং ইয়ার্ড তৈরি করা হচ্ছে, যা আগামী আগস্টের মধ্যে শেষ করার চেষ্টা করছে বিসিক। সিইটিপির বর্জ্য পরিশোধনের কাজ চলছে। তবে স্বয়ংক্রিয়করণ বাকি। মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক ‘ক্রোমিয়াম রিকভারি ইউনিট’ এখনো চালু হয়নি।
সিইটিপির কাজই এখন বন্ধ। চীনা ঠিকাদারের কর্মীরা করোনাকালে চীনে ছিলেন। তাঁরা ফিরেছেন। এখন আবার কাজ শুরু হবে। অবশ্য এর আগে বিসিক গত ডিসেম্বরের মধ্যেই কাজ শেষ করার ঘোষণা দিয়েছিল। এরপর দেখা গেল, ছয় মাস প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সেই ছয় মাস গত মাসে শেষ। এখন আবার মেয়াদ এক বছর বেড়েছে।
‘মিথ্যা তথ্য’
২০১৬ সাল থেকেই বিসিকের চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পের তখনকার পরিচালক আবদুল কাইয়ুম বলে আসছিলেন, তাঁরা পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েছেন। এখন শুরু ট্যানারি সাভারে যাওয়ার অপেক্ষা। যেমন, ওই বছর ৩১ মার্চ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের তরফে প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি নেই। বর্জ্য পেলেই তা পরিশোধন করতে পারব। সিইটিপি আংশিক চালু করতেও সাড়ে ৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য দরকার।’
আবদুল কাইয়ুম সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে শুরুতে চামড়া সিইটিপির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ব্যুরো অব রিসার্চ টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেশনে (বিআরটিসি) চাকরি নেন। পরে যোগ দেন চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে।
দায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে গত রোববার আবদুল কাইয়ুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ছিলাম মাত্র এক বছর এক মাস। এ সময়ে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছি। সিইটিপির অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ করেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা তৈরি বলেছি মানে হলো বর্জ্য নিতে তৈরি। পুরোপুরি পারফর্ম করতে পারব, সেটা বলিনি।’ তিনি বলেন, ট্যানারির মালিকদেরও দায় আছে।
বিসিকের প্রস্তুতি দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ট্যানারিমালিকদের একাধিক দফা সময় বেঁধে দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু ট্যানারিমালিকেরা বলছিলেন, শিল্পনগর প্রস্তুত হয়নি। তাঁদের কথা কেউ শোনেনি। অবশেষে ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল উচ্চ আদালতের নির্দেশে ট্যানারির সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। ধীরে ধীরে সাভারে যেতে বাধ্য হয় ট্যানারিগুলো।
সাভারে গিয়ে যখন বর্জ্য বাড়ল তখন আর তা সামাল দিতে পারেনি বিসিক। চামড়ার উচ্ছিষ্ট ফেলা শুরু হলো ডাম্পিং ইয়ার্ড তৈরির জন্য খনন করা জায়গায়। ফলে সেখানে তৈরি হলো আস্তাকুঁড়। আর তরল বর্জ্য ফেলা শুরু হলো নদীতে। নদীর মাছ মরে উঠল। এ নিয়ে এলাকাবাসী বিক্ষোভও করেছিলেন।
এখন ট্যানারিমালিকেরা বলছেন, তখন আদালতকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে বিসিক।
সর্বশেষ পরিস্থিতি
চামড়াশিল্প নগরে গত শুক্রবার গিয়ে দেখা যায়, ২০১৭ সালে যে পরিস্থিতি ছিল, তার চেয়ে উন্নত হয়েছে রাস্তাঘাট। ভাঙাচোরা রাস্তা ঠিক করা হয়েছে। তবে কঠিন বর্জ্য এখনো খোলা আকাশের নিচে ফেলা হয়।
এখন বেশির ভাগ ট্যানারিতেই কাজ নেই। কিছু কিছু চলছে সক্ষমতার সামান্য অংশ ব্যবহার করে। ফলে তরল বর্জ্যের পরিমাণ খুবই কম। এর মধ্যেও পানিনিষ্কাশনের নালা নিয়ে বর্জ্য নদীতে পড়ছে। এ ছাড়া নৌকায় করে সিইটিপির পানি ফেলার পাইপের কাছে গিয়ে দেখা যায়, পাইপ থেকে যে পানি পড়ছে, তা কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত।
অবশ্য সিইটিপিতে যে বর্জ্য পরিশোধন করা হচ্ছে, তাতে মান রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে বলে দাবি করছে বিসিক। সিইটিপির পরামর্শক বুয়েটের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, বেশির ভাগ ট্যানারি এখন ক্রোমিয়াম ও সাধারণ বর্জ্য আলাদা করে দিচ্ছে। ফলে ক্রোমিয়ামের মাত্রা কমে গেছে।
কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের পরীক্ষা বলছে, এখনো পরিশোধনের মান যথোপযুক্ত নয়, কিন্তু আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। তবে সমস্যা হলো, এখন বর্জ্য কম। আসল অবস্থা কী দাঁড়ায়, তা বোঝা যাবে ঈদুল আজহার পর। গত জানুয়ারিতে, যখন বর্জ্যের পরিমাণ কিছুটা বেশি ছিল, তখনো নদীদূষণের কারণে বিসিককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। বিসিক সূত্রে নোটিশটি পাওয়া যায়।
১৬ জানুয়ারি পাঠানো ওই নোটিশে বলা হয়, চামড়াশিল্প নগরের বর্জ্য পরিশোধনাগার কার্যকরভাবে চালু নেই। ফলে অপরিশোধিত বর্জ্যে ধলেশ্বরী নদী মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। জবাবে বিসিক বলেছে, সিইটিপিতে বর্জ্য পরিশোধন কাঙ্ক্ষিত মাত্রার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় যাওয়ার লক্ষ্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ঈদুল আজহার পরে ট্যানারিগুলো থেকে যখন ব্যাপক বর্জ্যের চাপ শুরু হবে, তখন সামাল দেওয়া যাবে কীভাবে, জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক জিতেন্দ্রনাথ পাল বলেন, ‘আমরা রেশনিং করার কাজ করছি।’
উল্লেখ্য, সিইটিপির ক্ষমতা দৈনিক ২৫ হাজার ঘনমিটার। তবে ঈদুল আজহার পরে ট্যানারিগুলোতে ৪০ হাজার ঘনমিটার পর্যন্ত বর্জ্য তৈরি হয়।
রেশনিং মানে হলো বর্জ্য ট্যানারিতে রাখার ব্যবস্থা করে ধীরে ধীরে ছাড়া, যাতে চাপ কম পড়ে। এ জন্য ট্যানারিগুলোকে সংরক্ষণাগার করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আপত্তি আছে অনেক ট্যানারির। একটি ট্যানারির মালিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বলেন, কোনো কিছু ঠিকভাবে না করতে পেরে এখন নানা ফন্দিফিকির করছে বিসিক।
বিসিকের এ ধরনের টোটকা ব্যবস্থা খুব একটা কাজ করছে না। সিইটিপিতে লবণ পরিশোধনের ব্যবস্থা না রেখে বিসিক ট্যানারির মালিকদের বলেছিল, লবণ চামড়া থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। কিন্তু এখনো সিইটিপিতে পরিশোধিত পানিতে উচ্চমাত্রায় লবণ থাকছে।
৯ দফা সময় বৃদ্ধি
চামড়াশিল্প নগরে বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে সিইটিপি। এটি নির্মাণের জন্য ২০১২ সালের ১১ মার্চ কার্যাদেশ দেওয়া হয়। তখন দরপত্র মূল্য ছিল ৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৪৭৭ কোটি টাকা (তখনকার মূল্য ৭৪ টাকা ডলার ধরে)। কাজ শেষের সময় ধরা হয়েছিল ১৮ মাস। আর ছয় মাস ধরা হয়েছিল সিইটিপি কার্যকর করে বুঝিয়ে দেওয়ার।
নথিপত্রে দেখা যায়, চীনা ঠিকাদার জেএলইপিসিএল-ডিসিএল জেভিকে কাজের সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অন্তত নয়বার। তবু তারা কাজ শেষ করতে পারেনি।
ট্যানারির মালিকেরা চীনা ঠিকাদার ও সিইটিপি নির্মাণে পরামর্শকের দায়িত্ব পাওয়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ব্যুরো অব রিসার্চ টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেশনকে (বিআরটিসি) অযোগ্য বলে মনে করেন। তাঁরা বিভিন্ন সময় বলে আসছেন, চীনা ঠিকাদারকে বাদ দিয়ে কোনো ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিলে চামড়া খাতের এই পরিস্থিতি হতো না। বিআরটিসির বিষয়ে তাদের অভিযোগ, এই প্রতিষ্ঠানটির সিইটিপি নির্মাণের বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।
চীনা ঠিকাদার বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘ওরাই সব শেষ করেছে। আর ওদের প্রশ্রয় দিয়েছেন বিসিকের আগের কর্মকর্তারা।’
চামড়া এখন ৪ নম্বরে
চামড়া খাতকে দেশের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত হিসেবে গণ্য করা হতো। এটি ছিল দেশের রপ্তানি আয়ের দ্বিতীয় শীর্ষ খাত। এখন চামড়া ৪ নম্বরে নেমে গেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া খাতে রপ্তানি আয় ছিল ১২৩ কোটি ডলারের বেশি। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ৮০ কোটি ডলারে নেমেছে।
চামড়া খাত যে ডুবছে, তা বলছে সরকারই। প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গত ২২ জুন চামড়া খাত নিয়ে এক বৈঠকে এ মন্তব্য করে বলেন, ২০১৭ সালে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ কারখানা বা ট্যানারিগুলোকে হাজারীবাগ থেকে সাভারে নেওয়া হয়েছিল গায়ের জোরে। যদিও চামড়াশিল্প নগর তখন প্রস্তুত ছিল না।
জমি নিয়ে নতুন বিরোধ
ঢাকায় ট্যানারিগুলো আনা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ থেকে। ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সরকার জমি অধিগ্রহণ করে নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্যানারি ঢাকার হাজারীবাগে নিয়ে আসে। এখন হাজারীবাগের জমি খালি।
ট্যানারির মালিকদের অভিযোগ, হাজারীবাগে তাঁদের যে জমি আছে তা ‘রেড জোনে’ ফেলে রেখেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এতে তাঁরা জমি বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে পারছেন না। অন্যদিকে সাভারে চামড়াশিল্প নগরের জমির দামের সঙ্গে নতুন করে সুদ চাইছে বিসিক।
সরকার গত বছর মে মাসে চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পের জমির দাম প্রতি বর্গফুট ৪৭১ টাকা নির্ধারণ করে। সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এখন বিসিক সুদ চাচ্ছে। ফলে প্রতি বর্গফুটের দাম দাঁড়াচ্ছে ৬২৫ টাকার বেশি। তিনি বলেন, ‘আমরা এ টাকা দিতে রাজি নই। কারণ, প্রকল্প দেরি হয়েছে তাদের কারণে।’
মানসনদ কত দূর
পরিবেশদূষণের কারণে বৈশ্বিক বড় ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের চামড়া কেনে না। এ জন্য অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে চামড়া আমদানি করে পণ্য তৈরি করে রপ্তানি করে। ব্র্যান্ডগুলোর কাছে দেশি চামড়ায় তৈরি চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করার জন্য দরকার সিইটিপির লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) মানসনদ।
শিল্প মন্ত্রণালয় গত বছর অক্টোবর মাসে চামড়াশিল্প নগরের সিইটিপি প্রকল্পের সার্বিক বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভা শেষে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ‘আগামী বছরের (২০২০) শুরুর দিকে চামড়াশিল্পের জন্য বাংলাদেশ এলডব্লিউজি সনদ অর্জনে সক্ষম হবে।’
বিশ্বে এলডব্লিউজির সনদপ্রাপ্ত চামড়া উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৪৩। এর মধ্যে পাশের দেশ ভারতেই ১৩৯টি উৎপাদনকারী রয়েছে। বাংলাদেশে তিনটি ট্যানারি এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, অস্টন লিমিটেড ও রিফ লেদার। একটিও সাভার চামড়াশিল্প নগরের নয়।
মানসনদ কত দূর, জানতে চাইলে বিএফএলএলএফইএর সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এলডব্লিউজি দূরের কথা, আগে আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের মান অনুযায়ী সিইটিপি প্রস্তুত করে দিক।’
মাশুল মানুষের
চামড়াশিল্প নগর প্রকল্পের ব্যর্থতায় মাশুল দিতে হচ্ছে মানুষকেই। একদিকে করদাতাদের বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। অন্যদিকে তাঁরাই চাকরি হারাচ্ছেন, তাঁরাই চামড়ার দাম পাচ্ছেন না।
গতবার পবিত্র ঈদুল আজহায় চামড়া খুব কম দামে বিক্রি হয়। একাংশ নষ্টও হয়। এবার চামড়ার দাম বেশ কমিয়ে ধরেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে চামড়া রপ্তানিরও চিন্তা করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে কেরানীগঞ্জের লংকারচরের হজরত আলী ধলেশ্বরী নদীর পানি হারিয়েছেন। তেমনি জীবিকা হারিয়েছেন জাকির হোসেন। চামড়া শিল্পনগরের একটি ট্যানারির এই কর্মী বলেন, ‘দুই বছরে অনেকের চাকরি গেছে। মালিক তো এখন ট্যানারি বন্ধ করে দিতে পারলেই বাঁচেন।’