ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে পুরোনো আইনের আদলেই নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন হচ্ছে। নতুন আইনে ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে একক হার থাকছে না। পুরোনো আইনের সাতটি হারের পরিবর্তে নতুন আইনে সব মিলিয়ে পাঁচটি ভ্যাট হার হচ্ছে। এই হারগুলো হলো ২, ৫, ৭.৫, ১০ ও ১৫।
আবার পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক ভ্যাট ব্যবস্থাও পুরোপুরি হবে না। হিসাব–নিকাশ ব্যবস্থাও আগের মতোই খাতা–কলমে রাখা যাবে। সীমিত পরিসরে অনলাইনভিত্তিক ভ্যাট রিটার্ন জমা, ভ্যাট পরিশোধের সুযোগ দিয়ে আপাতত নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হবে।
তবে পুরোনো আইনের প্যাকেজ ভ্যাট থাকছে না। কোনো পণ্য বা সেবায় ১৫ শতাংশ ছাড়া অন্য ভ্যাট হার প্রযোজ্য হলে ব্যবসায়ীদের রেয়াত নেওয়ার সুযোগ না–ও থাকতে পারে বলে এনবিআরের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।
দুই বছর সময় পেলেও এনবিআর নতুন আইন বাস্তবায়নে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিতে পারেনি। নতুন আইনে অনলাইনে রিটার্ন জমা, ভ্যাট পরিশোধসহ যাবতীয় কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালনার করার কথা ছিল। কিন্তু ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কী ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করবে, তা চূড়ান্ত করা যায়নি। আমদানিমূল্যে ৫০ হাজার ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) ব্যবসায়ীদের দেওয়ার কথা থাকলেও তা দিতে পারেনি এনবিআর।
নতুন ভ্যাট আইন কতটা বাস্তবায়নযোগ্য—এই বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত ২৭ মে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে তো শুরু করি। কোনো সমস্যা থাকলে তা সমাধান করা যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সারা দেশে যত বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে, এর ৯০ শতাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান (এসএমই)। তাদের কাছে পৌঁছাতে পারলে আমরা অনেক ভ্যাট পাব। এখন তো ঈদ, পয়লা বৈশাখ, খেলাসহ বিভিন্ন উপলক্ষে বিপুল বেচাকেনা হয়। সেখান থেকেও আমরা ভ্যাট পাই। এখন খরচের ওপর নির্ভর করে প্রবৃদ্ধি হয়। খরচ করলেই ভ্যাট পাব।’ নতুন ভ্যাট আইন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ১ জুলাই থেকে নতুন আইন বাস্তবায়ন শুরু হলেও এনবিআর আইনটি বাস্তবায়নে আপাতত কঠোর অবস্থানে যাবে না। ব্যবসায়ীদের দেওয়া হিসাব-নিকাশ, ভ্যাট রিটার্নই মেনে নেবে। অনেকটা পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়নের মতো করে নতুন আইনটি চালু হবে। কোথাও কোনো সমস্যা হলে তা তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ জন্য সব ব্যবসায়ী সংগঠনে বিশেষ পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর মাঠপর্যায়ে কোনো সমস্যা হলে এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করবে সরকার। যেমন রেয়াত নিতে না পারলে পণ্যের দাম বাড়তে পারে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সব ব্যবসায়ী চেম্বার ও সমিতির সভাপতিদের এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি গঠনের অনুরোধ করেছে এফবিসিসিআই।
পার্থক্য কম
নতুন ও পুরোনো আইনের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। প্যাকেজ ভ্যাট ছাড়া প্রায় সবই বহাল থাকছে। একাধিক ভ্যাট হার, টার্নওভার কর থাকবে। বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক হারও বহাল রাখার জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিদ্যমান পুরোনো আইনে ২, ৩, ৪.৫, ৫, ৭, ১০ ও ১৫—এই সাতটি ভ্যাট হার আছে। নতুন আইনে ভ্যাট হার হচ্ছে পাঁচটি। এগুলো হলো ২, ৫, ৭.৫, ১০ ও ১৫। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, পণ্য বা সেবা আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ, উৎপাদনে ১০ শতাংশ, পাইকারি পর্যায়ে ৭.৫ শতাংশ এবং খুচরায় ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হবে। প্রথমে চারটি ভ্যাট হার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এখন আরেকটি নতুন হার করা হচ্ছে। এত দিন যেসব পণ্য বা সেবায় ট্যারিফ মূল্য ও সংকুচিত ভিত্তিমূল্যের ওপর ভ্যাট দিত, সেখানে ২ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণ করা হচ্ছে।
এ ছাড়া মৌলিক খাদ্য, নির্ধারিত জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, গণপরিবহন সেবা, গণস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কৃষি, মৎস্য চাষ, দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অবাণিজ্যিক কার্যক্রম, অলাভজনক সাংস্কৃতিক সেবা—এসব ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এই তালিকায় ১ হাজার ৯৮৩টি পণ্য ও সেবা আছে।
নতুন ভ্যাট আইনটি সংশোধন করে আরও বেশ কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালের মূল আইনে বলা হয়েছিল, কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ টাকার কম হলে কোনো ভ্যাট দিতে হবে না। এখন তা বাড়িয়ে ৫০ লাখ টাকা করা হয়েছে। টার্নওভার করের সীমা ন্যূনতম বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৮০ লাখ টাকা করা হয়েছে। এখন থেকে ৮০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা বার্ষিক লেনদেন হলে টার্নওভার কর দিতে হবে। টার্নওভার করহার ৩ শতাংশের পরিবর্তে ৪ শতাংশ করা হচ্ছে।
নতুন আইনে একাধিক ভ্যাট হার হওয়ায় রেয়াত নেওয়ায় সমস্যা তৈরি হতে পারে। রেয়াত নেওয়ার কৌশল পরিষ্কার করেনি এনবিআর। এনবিআরের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ১৫ শতাংশ ছাড়া অন্য ভ্যাট হারের ক্ষেত্রে রেয়াত নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না।
নতুন ভ্যাট আইন সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ শতাংশের পরিবর্তে আরও কম হারের একটি একক ভ্যাট হার থাকলে ভালো হতো। হিসাব-নিকাশ করা সহজ হতো। এতে ভ্যাট রেয়াত নেওয়ার ক্ষেত্রে কারসাজি করার সুযোগ কম। তিনি মনে করেন, বর্তমানে স্বয়ংক্রিয় হিসাবব্যবস্থা বা ইসিআর মেশিন নেই। আবার কোনো রসিদ দেওয়া হয় না। ব্যাপকভাবে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। একটি নতুন আইন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, কিন্তু এসব বিষয় কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেই বিষয়ে বাস্তবে উদ্যোগ নেই।
অনেক কিছুই হয়নি
২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে নতুন ভ্যাট আইন চালু হওয়ার কথা ছিল। ওই বছর বাজেট ঘোষণার পরও একক ১৫ শতাংশ ভ্যাট হারের পরিবর্তে একাধিক ভ্যাট হারের দাবিতে ব্যবসায়ীরা অনড় থাকেন। শেষ পর্যন্ত চালু হওয়ার দুই দিন আগে আইনটি দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়।
দুই বছর আগেই এফবিসিসিআই নতুন আইনের প্রভাব মূল্যায়ন করার জন্য সমীক্ষা করার দাবি করেছিল। এনবিআর সেটি করতে পারেনি। নতুন আইনের হিসাব–নিকাশ করার জন্য সফটওয়্যার ব্যবহারে খুব বেশি অগ্রগতি নেই। এনবিআর ১১টি সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। তবে এখনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ওই সব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সফটওয়্যার তৈরি করেনি। উল্লেখ্য, বার্ষিক ৫ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়, এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এই সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এনবিআর দুই বছর আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিজেদের বেচাকেনার হিসাব রাখার জন্য কেনা দামে ৫০ হাজার ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) মেশিন দেবে এনবিআর। সেটাও দিতে পারেনি সংস্থাটি।
আয়কর
আগামী বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের জন্য সুখবর আসতে পারে। করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ থেকে ২০-২৫ হাজার টাকা বাড়ানো হতে পারে। বিনিয়োগে কর রেয়াতের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। সরকারের নির্দিষ্ট কিছু খাতে (যেমন-সঞ্চয়পত্র) বিনিয়োগ করলে কর রেয়াত পাওয়া যায়। এখন আয়ের ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করলে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কর রেয়াত পাওয়া যায়। এটি এবার এককভাবে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে। এতে যাঁরা বেশি আয় করেন, তাঁরা বেশি কর রেয়াত সুবিধা পাবেন।
এ ছাড়া আগামী বাজেটে ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে করের পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এলাকাভিত্তিক বিদ্যমান করের হারের ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে বার্ষিক মুনাফার করমুক্ত সীমা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হতে পারে।