ফারমার্স ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। অন্য ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে ব্যাংকটি। নিচ্ছে উচ্চ সুদে আমানত। নিয়ম মেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে না পারায় গত এক বছরে সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জরিমানা দিয়েছে এই ব্যাংক। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে আমানতকারীদের দায় পরিশোধেরও ক্ষমতা হারিয়েছে ব্যাংকটি।
এই হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া বেসরকারি এই ব্যাংকের আর্থিক চিত্র। একই দশা একইভাবে অনুমোদন পাওয়া এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেরও।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক প্রতিবেদন থেকে ব্যাংক দুটি সম্পর্কে এ তথ্য পাওয়া গেছে। আজ রোববার অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২১তম সভায় উপস্থাপনের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
দি ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি বর্তমানে সরকারি হিসাব-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি। আর এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ফরাছত আলী।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে বেসরকারি খাতে অনুমোদন পাওয়া ৯ ব্যাংকের মধ্যে খেলাপি ঋণের শীর্ষে রয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। ২০১৩ সালের জুনে যাত্রা করা ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ গত জুন শেষে হয়েছে ৩০৬ কোটি টাকা।
প্রকৃত হিসাব করা হলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। একই বছরের এপ্রিলে যাত্রা করা এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৯১ কোটি টাকা।
প্রবাসীদের উদ্যোগে গঠিত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের মূলধন জোগান থেকে ঋণ দেওয়া—সব ক্ষেত্রেই বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আহসানকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে। অনিয়মের জন্য এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেওয়ান মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত শুনানি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের কাছে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এসব ব্যাংকের মালিকপক্ষ রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী। তাদের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করার দক্ষতা বাংলাদেশ ব্যাংক রাখে না। এ জন্য সরকারি ব্যাংকের মতো বেসরকারি ব্যাংকগুলোও খারাপ হয়ে পড়ছে। এখন মূল কাজ হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করা। কেউ যেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, ‘ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হলে পর্যবেক্ষক দেওয়া হয়। তিনি ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় উপস্থিত হয়ে খোঁজ রাখেন। আগের যেসব অনিয়ম হয়, তা এক দিনেই তো সমাধান হয় না।’
ফারমার্স ব্যাংকের অবনতি
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কার্যক্রম শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই ঋণ বিতরণে অনিয়ম করে ব্যাংকটি। এর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাও শিথিল হয়ে পড়ে। অস্তিত্ববিহীন ও সাইনবোর্ড-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান এবং নিয়ম ভেঙে নিজ ব্যাংক ও অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ দেয় এ ব্যাংক। এমনকি ব্যাংকটি খেলাপি গ্রাহকদের ঋণ দেয় ও অন্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণও কিনে নেয়। লোকবল নিয়োগেও অনিয়ম করেছে ব্যাংকটি। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর আমানতের ১৯ শতাংশ (সিআরআর ও এসএলআর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাধ্যতামূলক জমা রাখতে হয়। কিন্তু ফারমার্স ব্যাংক রক্ষিত নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। অর্থাৎ, ব্যাংকটিতে তারল্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত জানুয়ারি ও জুন মাসে কয়েক দিন সংবিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) রাখতেও ব্যর্থ হয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। এ কারণে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে গত জুন পর্যন্ত ৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে ব্যাংকটিকে। এ ছাড়া গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ ব্যাংকের ওপর আরও ১১ কোটি ৩১ লাখ টাকা দণ্ডসুদ ও জরিমানা আরোপ হয়েছে, যা আদায়ের প্রক্রিয়া চলছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে।
ব্যাংকটির দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই উল্লেখ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাধারণ আমানতকারী ও বিভিন্ন ব্যাংক হতে উচ্চ সুদে আমানত নেওয়া এবং ধার করে বর্তমানে টিকে আছে ফারমার্স ব্যাংক। ফলে ব্যাংকটি পুরো ব্যাংক খাতে ‘পদ্ধতিগত ঝুঁকি’ (সিস্টেমেটিক রিস্ক) তৈরি করেছে, যা আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট করতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে গত জানুয়ারিতে নতুন শাখা খোলা ও ঋণ দেওয়ায় কিছুটা লাগাম টানে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যাংকটি তা-ও মানেনি। নতুন ঋণ অনুমোদন ও ঋণসীমা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা না মেনে ব্যাংকটি নতুন ঋণ দেওয়া ও ঋণসীমা বাড়ানো অব্যাহত রেখেছে। এসব কারণে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ফারমার্স ব্যাংক লোকসান করেছে ১৩ কোটি টাকা এবং ৫৪ শাখার মধ্যে ২৮টিই লোকসানি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকটির মালিকানায় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা থাকায় তাঁরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নির্দেশনাই মানেন না।
ফারমার্স ব্যাংকের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও এমডি এ কে এম শামীমকে গতকাল ফোনে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
অনিয়ম এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেও
কার্যক্রম শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই এ ব্যাংকে পরিচালকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ঋণ অনিয়ম ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থায় ঘাটতি দেখা যায়। এ কারণে ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর এ ব্যাংকেও পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার সময় বিদেশ থেকে মূলধন আনার ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়। প্রবাসীর পরিবর্তে বেনামে বাংলাদেশে বসবাসকারী ব্যক্তিরাই শেয়ার কেনেন। অনুপস্থিত পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল করে উপস্থিতি দেখিয়ে পর্ষদ সভার কার্যবিবরণীও প্রস্তুত করে এই ব্যাংক। নিয়মকানুন না মেনে ঋণ দেওয়া হয় মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আহসানকে। এ ছাড়া বেআইনিভাবে এক পরিচালকের অনুপস্থিতিতে তাঁর শেয়ার হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংক। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই সাব্বির আহমেদ মুবিন নামের একজনকে পরিচালক নিয়োগ দেয়।
অনিয়মের কারণে ব্যাংকটির নিট মুনাফা কমে গেছে। ২০১৬ সালের প্রথম ছয় মাসে নিট মুনাফা হয়েছিল ৮৬ কোটি টাকা। তবে চলতি বছরের একই সময়ে মুনাফা কমে হয় ১২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ২০১৬ সালেই ব্যাংকটির ৭০১ কোটি টাকার ঋণে গুরুতর অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসে। ওই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বলা হয়, আমানতকারীদের স্বার্থে ও জনস্বার্থে ব্যাংক চালাতে ব্যর্থ হয়েছে ফরাছত আলীর নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ। আর এমডি দেওয়ান মুজিবুর রহমান ব্যর্থ হয়েছেন ব্যাংকটিতে যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে। এমনকি তাঁরা গুরুতর প্রতারণা ও জালিয়াতি করেছেন, যা ফৌজদারি অপরাধ।
আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় চলতি বছরের ২০ মার্চ অবশ্য ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও এমডিকে নোটিশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এমডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার শেষ ধাপ হিসেবে ১৭ অক্টোবর থেকে তার শুনানি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ফরাছত আলী ও এমডি দেওয়ান মুজিবুর রহমানকে গতকাল চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। বিষয়বস্তু উল্লেখ করে খুদে বার্তা দিলেও কোনো জবাব দেননি তাঁরা।