কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের যুগে বাংলাদেশের সফটওয়্যার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টিকন সিস্টেমস লিমিটেড উদ্ভাবনী ও সৃজনশীলতায় মানুষের মন জয় করেছে। ‘লেটস এনজয় পাওয়ার অব সলিউশন’ স্লোগান নিয়ে টিকন স্থানীয় রিসোর্স বা উপাদান কাজে লাগিয়ে গবেষণাভিত্তিক বিভিন্ন প্রকল্প, বৈশ্বিক বাজারের উপযোগী সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনসহ আউটসোর্সিংয়ের সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখন পরিচিত একটি নাম। বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের সফটওয়্যার খাতকে তুলে ধরতে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে ২০০৭ সালে টিকন সিস্টেমের যাত্রা শুরু।
শুরুর দিকে কোরিয়ার স্থানীয় স্টার্টআপ কোম্পানি হামিং কমিউনিকেশনের সঙ্গে শিক্ষামূলক কনটেন্ট অ্যাপ্লিকেশনের কাজ দিয়ে টিকন কাজ শুরু করে। বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই), ক্লাউড কম্পিউটিং, এআর, ভিআর, ব্লকচেইনসহ নতুন প্রযুক্তি নিয়ে বৈশ্বিক গ্রাহক উপযোগী নানা সেবা দেয় টিকন। বৈশ্বিক বাজারের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিয়ে কোরিয়া-জাপানের মতো দেশেও উন্নত প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন গ্রাহককে সেবা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে দেশীয় গ্রাহকদের জন্য কাজ করার ফলে ফলে নিত্যনতুন প্রযুক্তি ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগানো হচ্ছে।
টিকনের উন্নয়ন করা মাল্টি ল্যাঙ্গুয়েজের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চ্যাটবটের সার্ভিস ব্যবহার করছে কোরিয়া আর জাপানের বেশ কিছু গ্রাহক। টিকনের চ্যাটবটে সমর্থন করে জাপানিজ, কোরিয়ান, ইংরেজির সঙ্গে বাংলা ভাষা। এর স্পিচ রিকগনিশন টেকনোলজি ব্যবহার করে বিগ ডেটা, আইওটির অ্যাপ্লিকেশনের জন্য ডিপলার্নিং বা মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিয়ে কাজ করছে টিকনের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টিম। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, টিকনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রযুক্তি কলসেন্টার, হেল্প সেন্টার, চিকিৎসা, কৃষি আর্থিক সেবা খাতসহ নানা খাতে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এতে আর্থিক সাশ্রয়সহ ব্যবসায় গতি আনতে সহায়তা করবে। সম্প্রতি টিকন ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের উপযোগী সফটওয়্যার অ্যাজ আ সার্ভিসভিত্তিক (সাস) বিজনেস সলিউশন ম্যানেজার (ManagR) তৈরি করেছে, যা পরীক্ষামূলকভাবে দেশ ও বিদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, অ্যাকাউন্টিং, ইনভেন্টরি, পে-রোল, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বৈশ্বিক সফটওয়্যার বাজারে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার প্রত্যয়ে কাজ করছেন টিকনের প্রধান নির্বাহী এম এন ইসলাম। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০০৬ সালে কোরিয়ান আইটি এসএমই অ্যাসোসিয়েশন থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মোহাম্মদ আজাহারউদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম, প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা বখতিয়ার রহমান, গবেষণা বিভাগের প্রধান এমদাদুল হক, ব্যবসা পরিচালক, ফকরুদ্দীন আহম্মেদ, সফটওয়্যার উন্নয়ন বিভাগের প্রধান আনাস বিন নোমান, কো-অর্ডিনেটর বিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এস এম মসিউর রহমানসহ একঝাঁক তরুণ কাজ করছেন। টিকনের সেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে টোটাল মিডিয়া সলিউশন, স্ট্রিমিং ইঞ্জিন, ট্রান্সকোডার, বিজ্ঞাপন প্ল্যাটফর্ম, সাবটাইটেল জেনারেটর, বিলিং, সিএমএস বা কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ইত্যাদি। এর বাইরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চ্যাটবট, বিগ ডেটার অ্যাপ্লিকেশন, মেশিন লার্নিং এবং ডিপলার্নিং প্রযুক্তি, এসএমই এবং এন্টারপ্রাইজের জন্য সাস প্ল্যাটফর্ম, ওয়েব ক্রলার প্রযুক্তি, ট্রিভিয়া গেম সলিউশন, জিপিএস ট্র্যাকিং সলিউশন, অডিও ও ভিডিও প্রযুক্তি, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, ক্লাউড কম্পিউটিং ও ডেটা ভার্চ্যুয়ালাইজেশন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা অ্যাপ্লিকেশন, অডিও, ভিডিও কল, চ্যাটিং অ্যাপ, কনফারেন্স সিস্টেম, ই-কমার্সসহ নানা খাতে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান এইচডি টেলিকম, এসআইইরওএইচ, এনিটক করপোরেশন, রিয়েলস্ট্রিম, গ্রেস গ্লোবাল, টিডব্লিউ মোবাইল, ইউস্টার, জাপানি প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইনোভেশন, উইল কো. দেশে কনটেন্টসম্যাটারের সঙ্গে কাজ করছে টিকন। ইউটিউবের বাইরে নিজস্ব বিজ্ঞাপনের ইনভেন্টরি ম্যানেজ করে টিকনের মিডিয়া সলিউশন ব্লেসবিট কোরিয়া, জাপান, বাংলাদেশসহ উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু ওটিটি সার্ভিস, ডিজিটাল ব্রডকাস্টার, আইপি টিভি সার্ভিস প্রোভাইডারেরা ব্যবহার করছে। গত বছর থেকে টিকন মিডিয়া সলিউশনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে। প্রথম বাংলাদেশি কোম্পানি হিসেবেটিকন সিস্টেম আমাজন ওয়েব সার্ভিসের টেকনোলজি পার্টনার হিসেবে স্বীকৃত লাভ করেছে। সিডিএন আর আমাজন ওয়েব সার্ভিসেস বেটার আর্কিটেকচারে ডিজাইনে সমৃদ্ধ ব্লেজবিট মিডিয়া সলিউশনের প্রশংসা করে আমাজন ওয়েব সার্ভিস আর্কিটেক্ট টিমের অনেকেই। ২০১৯ সালে (বিজনেস সলিউশন ক্যাটাগরিতে) বেসিস ন্যাশনাল আইসিটি পুরস্কার পায় ব্লেসবিট ও টিকন। ২০১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে টিকনের ব্লেজবিট র্যাবিটহোলবিডিতে সেবা দিয়েছিল, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি মানুষ ওটিটি প্ল্যাটফর্মে লাইভে খেলা দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল।
টিকনের কর্মকর্তারা বলেন, গত কয়েক বছর ক্লাউড সেবা ও ডেটা ভার্চ্যুয়ালাইশেন নিয়ে কাজ শুরু করেছে টিকন। কনসালটেন্সি, ক্লাউড ডিপ্লয়মেন্ট, ক্লাউড মাইগ্রেশনসহ ক্লাউড সেবা নিয়ে নানা ধরনের ম্যানেজ সার্ভিস দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। আমাজন ওয়েব সেবার পাশাপাশি মাইক্রোসফটের আজুরে, গুগল ক্লাউড বা আলিবাবা ক্লাউড নিয়েও কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে টিকনের। গত এক যুগের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তথ্যপ্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকনের ঝুলিতে থাকা সাফল্য এসেছে মূলত প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের পেশাদারির কারণেই।