১৬৩০ সালে ইংল্যান্ডের রাজা চার্লসের জন্মকে স্মরণ করে বিস্কুট দিবসের প্রবর্তন হয়। যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রেও বিস্কুট দিবস জোরেশোরে পালন করা হয়। অন্যান্য দেশেও দিবসটি পালিত হয়। বাংলাদেশে বিস্কুট জনপ্রিয় হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটি পালিত হওয়ার তথ্য নেই।
সময় বদলেছে। নিত্যদিনের খাবারের তালিকায় যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন পদ। তবে শরীর ও মনকে চাঙা করতে এক কাপ চায়ের সঙ্গে ‘টা’ হিসেবে বিস্কুটের ‘সন্ধি’ আগের মতোই আছে। এ কারণে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোট খিদে মেটানোর এ খাবারের জনপ্রিয়তা বাড়ছেই।
সম্ভাবনা থাকায় বিস্কুট উৎপাদনে থাকা পুরোনো কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। আবার আসছে নতুন কোম্পানিও। গত বছর করোনার মধ্যেই দুটি বড় শিল্পগোষ্ঠী বিস্কুটের বাজারে এসেছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে প্রায় সব কোম্পানিই নতুন নতুন স্বাদের বিস্কুট আনছে। দামেও আছে বৈচিত্র্য। সব মিলিয়েই দেশের বিস্কুটের বাজার বড় হচ্ছে।
দেশের বিস্কুটের বাজার কত বড়, এর কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। একাধিক কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা জানান, দেশের বিস্কুটের বাজার প্রায় ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকার। তার মধ্যে ব্র্যান্ডের বিস্কুটের বাজার প্রায় অর্ধেক, ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বিস্কুটের এ বাজার বড় হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ময়দা, তেল, চিনিসহ সব ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। ফলে বিস্কুটের দামই বাড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে কিছু কোম্পানি তাদের পণ্যের দাম বৃদ্ধি করেছে। কিছু কোম্পানি হিসাব–নিকাশ করছে, শিগগিরই দাম বাড়ানোর পথে হাঁটবে।
বিস্কুটের বাজারটি মোটাদাগে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। এগুলো হলো সাধারণ বেকারির তৈরি বিস্কুট, ছোট ছোট অঞ্চল বা এলাকাভিত্তিক ব্র্যান্ডের বিস্কুট এবং প্রতিষ্ঠিত বড় কোম্পানির কারখানায় উৎপাদিত বিস্কুট। ব্র্যান্ডের বিস্কুটের দাম আগের চেয়ে কমে আসায় সেগুলোর বিক্রি প্রতিবছরই বাড়ছে। তা ছাড়া করোনাকালে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্র্যান্ডের বিস্কুটের জনপ্রিয়তা আরেক ধাপ বেড়েছে। অলিম্পিক, হক, নাবিস্কো, ড্যানিশ, রোমানিয়া, কোকোলা, প্রাণ, কিষোয়ান, ওয়েল ফুড, আকিজ, ফ্রেশ, ড্যান কেক—এগুলোই বিস্কুটের বাজারে এখন বড় ব্র্যান্ড।
বর্তমানে দেশের বাজারে সাধারণ বিস্কুট থেকে শুরু করে আলু, জিরা, ক্রিম, চকলেট, ওয়েফার, টোস্ট, মসলা, নোনতা, বাদাম, দুধ, ঘি, ঝাল, সবজি, গ্লুকোজ, কফি, স্ট্রবেরি, কমলাসহ নানা স্বাদের বিস্কুট বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য চিনি ছাড়া বিস্কুট ও হজমে উপকারী ডাইজেস্টিভ বিস্কুট এনেছে কয়েকটি কোম্পানি। আবার মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের মধ্যে জনপ্রিয় হচ্ছে কুকিজ। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নানা স্বাদের বিস্কুট উৎপাদন করায় আমদানি ব্যাপক হারে কমেছে। তাতে সাশ্রয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার।
বিস্কুটের কথা বলতে হলে প্রথমেই বলতে হয় অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের কথা। দুই যুগ ধরে বিস্কুট ও কনফেকশনারির বাজারে বেশ দাপটের সঙ্গেই ব্যবসা করে যাচ্ছে কোম্পানিটি। ১৯৭৯ সালে যাত্রা শুরু করা এ কোম্পানির বিস্কুট ও কনফেকশনারি ব্যবসা শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। বর্তমানে দেশের বিস্কুটের বাজারে সিংহভাগ অংশীদারত্ব এ কোম্পানির। রপ্তানিতেও তারা দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৩৬টি ব্র্যান্ড নামে বিস্কুট বিক্রি করে। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এনার্জি প্লাস, নাটি, টিপ ও ফাস্ট চয়েজ বিস্কুট।
অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বর্তমানে সারা দেশে মাসে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার ব্র্যান্ডের বিস্কুট বিক্রি হয়। ননব্র্যান্ডের বিস্কুট ধরলে সেটি হবে ৯০০ কোটি টাকার বেশি। তার মধ্যে অলিম্পিকের বিক্রি ২০০ থেকে ২১০ কোটি টাকা।
সম্ভাবনা থাকায় গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে পণ্যের ব্যবসায় নামে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী আকিজ ইনসাফ গ্রুপ। এ জন্য আকিজ বেকার্স লিমিটেড নামের নতুন প্রতিষ্ঠানে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তারা। বর্তমানে দুটি ব্র্যান্ডে বিস্কুট, কুকিজসহ বিভিন্ন ধরনের বেকারি পণ্য উৎপাদন করছে আকিজ বেকার্স।
জানতে চাইলে আকিজ বেকার্সের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রেতারা সব সময়ই মানসম্মত পণ্য পছন্দ করেন। বিস্কুটের ক্ষেত্রেও সেটির প্রমাণ পেয়েছি। গত এক বছরে আমরা ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেয়েছি। আমাদের লক্ষ্য, তিন বছরের মধ্যে আমরা বিস্কুটের বাজারের তৃতীয় শীর্ষস্থানে পৌঁছানো।’ তিনি জানান, বর্তমানে মাসে ১৬ থেকে ১৭ কোটি টাকার বিস্কুট ও কুকিজ বিক্রি করছে আকিজ বেকার্স।
২০১২ সালে বিস্কুটের বাজারে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। বিস্কুটের পাশাপাশি রুটি, কেক ও পেস্ট্রির মতো বেকারি পণ্যও আছে প্রতিষ্ঠানটির। বর্তমানে বিস্ক ক্লাব, পটাটা, ফ্রুট ফান, মিল্কিস, হ্যাটট্রিক, ফিট প্যাকার্স নামে ১০টি ব্র্যান্ডের বিস্কুটের বিক্রি করছে তারা।
জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, দেশে গত দুই দশকে বিস্কুটের ব্যবসায় বড় রূপান্তর হয়েছে। সেটি হচ্ছে, মানুষ ননব্র্যান্ডের বিস্কুট ছেড়ে ব্র্যান্ডের পণ্যে ঝুঁকেছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় কোম্পানিগুলো মানসম্পন্ন বিস্কুট উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছে। তাতে আমদানি কমেছে।
২০১৫ সালে ডেনমার্কের ড্যান কেকের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে বাংলাদেশে ড্যান ফুডস লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে পান্ডুঘর। গত বছর ড্যান ফুডস বাজারে নিয়ে আসে উন্নত মানের কুকিজ।
জানতে চাইলে ড্যান ফুডসের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা শাহীদ বিন সারোয়ার বলেন, বাংলাদেশের অনেকেই এখন ব্যবসা বা ভ্রমণে বিদেশে যান। সেখানে তাঁরা হোটেল-রেস্তোরাঁয় কুকিজ খেয়ে থাকেন। দেশে এসে তাঁরা কুকিজ খুঁজে বেড়ান। সেই চাহিদা মেটাচ্ছে ড্যান কেক। এতে দেশের মানুষ আমদানি হওয়া কুকিজের চেয়ে কম দামে ড্যান কেকের কুকিজ খেতে পারছেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো ব্রেড অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশীয় কোম্পানিগুলো মানসম্মত বাহারি বিস্কুট উৎপাদন করায় আমদানি কমেছে। ধীরে ধীরে ব্র্যান্ডের বিস্কুটের বাজারের হিস্যা বাড়ছে। এটা খুবই ইতিবাচক।’