করোনায় কর্মীবান্ধব এক শিল্পোদ্যোক্তা

দুই হাজার কর্মীর ভার নিলেন তিনি

স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিরাপদ দূরত্বে থেকে খাবার সংগ্রহ করছেন শ্রমিকেরা। মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরের কারখানায়। ছবি: সংগৃহীত
স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিরাপদ দূরত্বে থেকে খাবার সংগ্রহ করছেন শ্রমিকেরা। মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরের কারখানায়। ছবি: সংগৃহীত

টানা ৭৫ দিনের বেশি বাসার বাইরে অলিউল পারভেজ। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাগেরহাটে শ্বশুরবাড়িতে। এরপর থেকে কর্মস্থলেই থাকছেন তিনি। অথচ কর্মস্থল থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে রাজধানীর সাইনবোর্ড এলাকায় বাসা তাঁর। কিন্তু বাসার চেয়ে কর্মস্থলে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ বোধ করছেন অলিউল পারভেজ।

 কথা বলে জানা গেল, কর্মস্থলে থাকা–খাওয়া, চিকিৎসা কিংবা জরুরি কোনো প্রয়োজন, কোনো কিছুই নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে না পারভেজকে। প্রতিষ্ঠানই তাঁর থাকা–খাওয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে।

শুধু অলিউল পারভেজ নয়, তাঁর মতো আরও প্রায় দুই হাজার কর্মীর থাকা–খাওয়া, চিকিৎসা থেকে শুরু করে যাবতীয় সব দায়িত্ব নিয়েছে প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক সীকম গ্রুপ। এ গ্রুপেরই একটি প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার সিমেন্ট, যেটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। এ ছাড়া রয়েছে ডেলটা ব্র্যান্ডের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলএনজি, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি), তেল পরিশোধন, কনটেইনার ইয়ার্ডসহ নানা ধরনের ব্যবসা। গ্রুপটির পেছনের উদ্যোক্তা যিনি, তিনি মোহাম্মদ আমীরুল হক। মূলত তাঁর একক সিদ্ধান্তেই করোনাকালে কর্মীদের কারখানাস্থলে রেখে থাকা–খাওয়াসহ সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যার পুরো ব্যয় বহন করছে প্রতিষ্ঠান। সেটি ২৫ মার্চ, করোনার কারণে সরকারি সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগে থেকে।

গ্রুপটির শিল্পকারখানা রয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। সব িমলিয়ে কাজ করেন প্রায় সাত হাজার লোক। যার মধ্যে সরাসরি উৎপাদন সংশ্লিষ্ট দুই হাজার লোককে কারখানায় রাখা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কারখানার মধ্যে ঢাকার অদূরে মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরে প্রায় ১০০ একর জায়গা নিয়ে রয়েছে গ্রুপের সবচেয়ে বড় শিল্প এলাকা। এ ছাড়া চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও মোংলায় রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটির আরও শিল্পকারখানা। এ তিন প্রকল্প (কারখানা) এলাকাতেই শ্রমিকদের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সীকম গ্রুপ ও প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমীরুল হক

সবচেয়ে বেশি প্রায় ১ হাজার ৩০০ কর্মীর থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরের কারখানা এলাকায়, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানাধীন এলাকায় অবস্থিত ন্যাশনাল সিমেন্ট কারখানা এলাকায় প্রায় ৫০০ জন এবং মোংলা বন্দরসংলগ্ন এলাকায় স্থাপিত এডিবল অয়েল রিফাইনারি ও এলপিজির কারখানার অভ্যন্তরে ২০০ জনের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে কর্মকর্তা থেকে শুরু করে গাড়িচালক সবাই আছেন।

যাবে না চাকরি, কমবে না সুবিধা
করোনার কারণে বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীরা চাকরি নিয়ে বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রতিটি কর্মীর চাকরির নিশ্চয়তা নিশ্চিত করেছেন। শুধু চাকরির নিশ্চয়তা দিয়েই ক্ষান্ত হননি উদ্যোক্তা আমীরুল হক। করোনার ক্ষতি যতই হোক, কর্মীদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন কারও বেতন, সুযোগ–সুবিধা কোনো কিছুই এতটুকু কমবে না। বছর শেষে স্বাভাবিক বেতন বৃদ্ধিও অব্যাহত থাকবে নিয়ম অনুযায়ী। করোনাকালে কর্মীদের জন্য এ ধরনের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে আমীরুল হক বলেন, মূলত দুটি কারণে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে এ উদ্যোগ নিয়েছি। প্রথমত, আমি চাইনি, আমার শ্রমিক–কর্মচারীরা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে যাক। তাতে তাঁদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেত। দ্বিতীয়ত, দেশে বড় বড় কিছু অবকাঠামো প্রকল্পে আমাদের প্রতিষ্ঠান সিমেন্ট সরবরাহ করে। আমরা উৎপাদন বন্ধ করলে তাতে এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হতো। এ কারণে ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি শুরুর আগে উৎপাদন সচল রাখতে সংশ্লিষ্ট সব কর্মীকে কারখানা অভ্যন্তরে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির কারখানা এলাকায় কিছু কর্মীর আবাসন সুবিধা আগে থেকেই ছিল। করানোকালে বাড়তি শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করতে কারখানার ভেতরে তৈরি করা হয়েছে বাড়তি শেড। স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতেও নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। হ্যান্ড স্যানিটাইজার থেকে শুরু করে মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই সবকিছুরই ব্যবস্থা করা হয়েছে। অথচ করোনায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। উৎপাদনও কমেছে অর্ধেকের বেশি।

কেন এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ প্রশ্ন করা হলে আমীরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন পেশায় একজন আইনজীবী। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। ৮৪ সালে ব্যবসা শুরু করেছি। সেখান থেকে আজকের অবস্থানে এসেছি। কোনো যন্ত্র আমাকে রাতারাতি এত শিল্পের মালিক বানিয়ে দেয়নি। আমাকে এ পর্যায়ে এনেছেন যন্ত্রের পেছনে কাজ করা মানুষগুলো। সুদিনে তাঁরা প্রতিষ্ঠানকে অনেক কিছু দিয়েছেন, তাই এ খারাপ সময়ে অভিভাবক হিসেবে তাঁদের পাশে থাকার চেষ্টা করছি।’

সাধারণ মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কে আমীরুল হকের রয়েছে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিশাল এক কমিউনিটি সেন্টার। করোনার সংক্রমণ চট্টগ্রামে খুব বেশি তীব্র বা জটিল হওয়ায় ওই কমিউনিটি সেন্টারটিকে আইসোলেশন সেন্টার বা অস্থায়ী হাসপাতাল বানানোর জন্য প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করেন। সেটি করেই নিজের দায়িত্ব শেষ করেননি। প্রশাসনকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন সেটি পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব আর্থিক সহায়তা দেওয়ার। বর্তমানে ওই কমিউনিটি সেন্টারে অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরির কাজ চলছে বলে জানা গেছে।

আগামীর ভাবনা
আমীরুল হক বলেন, সরকার বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ প্রয়োজনীয় লোকজন আনার অনুমতি দিলে ভবিষ্যতে বিশ্বমানের একটি হাসপাতাল করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম মিলিয়ে তাঁর যে অফিস রয়েছে, সেগুলোকে ঢেলে সাজাবেন। নিশ্চিত করবেন নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে কর্মীদের বসার ব্যবস্থা করার। পাশাপাশি প্রয়োজনে ভবিষ্যতে যাতে কর্মীরা বাসায় থেকে কাজ করতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করা হবে। আর কারখানা এলাকায় বাড়ানো হবে আবাসন সুবিধা। আবাসনের জন্য বড় ধরনের বিনিয়োগের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছেন এ শিল্পোদ্যোক্তা।

করোনার ক্ষতি পোষাতে ভবিষ্যতে কর্মী ছাঁটাই বা আর্থিক সুবিধা কমানোর পথে যাবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আমীরুল হক বলেন, ৩৬ বছর ধরে ব্যবসা করছি। কমবেশি মুনাফা করেছি। এখন দুই বা তিন মাস ব্যবসা খারাপ বলে কর্মী ছাঁটাই করতে হবে, এটা ভাবলেই নিজের কাছে খারাপ লাগে। মনে হয় এত বছর ব্যবসা করে এক বছরের লোকসান বহন করার সক্ষমতাই যদি না থাকে, তাহলে এত বছর এ ব্যবসার মানে কী?