কল্পনার জগৎটাকে আপনি যদি এভাবে সাজান, রেলপথে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে এসে নামলেন কমলাপুর রেলস্টেশনে। সেখান থেকে পাতালরেলে করে খিলক্ষেত হয়ে কাওলা। সেখানে নেমে সুড়ঙ্গপথে চলে যাবেন হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে। বিমানবন্দরের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে উঠে গেলেন উড়োজাহাজে। এরপর নিজ গন্তব্যে। এ সময়ে পড়বেন না কোনো যানজটে। কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত দেখবেন না সূর্যের আলো।
না, এটি স্বপ্ন নয়, রূপ পেতে যাচ্ছে বাস্তবে। রাজধানীর কাওলা রেলস্টেশনকে তৈরি করা হচ্ছে শুধু হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে যাওয়ার জন্য। দেশ থেকে যাঁরা বিদেশ যাবেন বা বিদেশ থেকে যাঁরা দেশে আসবেন, তাঁদের যাত্রা সহজ করতে বিমানবন্দরকে সাজানো হচ্ছে এভাবেই।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে যেতে আপনি আরও একটি পথ ব্যবহার করতে পারবেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে আপনি সরাসরি চলে যেতে পারবেন নির্মিতব্য নতুন টার্মিনালে। বিমানবন্দর এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টার্মিনালে নামার জন্য রাখা হচ্ছে আলাদা ব্যবস্থা। ঠিক একই পথ ব্যবহার করে আপনি বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যেতেও পারবেন। সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রোহানি বাহরিনের নকশায় এভাবেই তৈরি করা হচ্ছে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালটি।
রোহানি বাহরিন হলেন সিঙ্গাপুরের সিপিজি কনসালট্যান্ট লিমিটেডের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের নকশাও তৈরি করেছিলেন রোহানি বাহরিন। বলা হচ্ছে, অনেকটা চাঙ্গি বিমানবন্দরের আদলেই তৈরি হচ্ছে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। রোহানি বাহরিনের নকশা বাস্তবায়ন করছে জাপানি দুই কোম্পানি মিতসুবিশি ও ফুজিতা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ট্রেডিং করপোরেশন।
দেশের প্রধান এ বিমানবন্দরে বর্তমানে দুটি টার্মিনাল রয়েছে। এ দুটি টার্মিনাল ১ লাখ বর্গমিটার জায়গার ওপর। তৃতীয় যে টার্মিনালটি হচ্ছে, সেটি বর্তমান দুটি টার্মিনালের দ্বিগুণের বেশি। ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার এলাকা। তৃতীয় টার্মিনালটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২১ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।
হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে নতুন করে শুধু একটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে, তা নয়। এর সঙ্গে সমান্তরালভাবে আরও চারটি কাজ হচ্ছে। টার্মিনালের পাশাপাশি দুটি হাইস্পিড ট্যাক্সিওয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এ দুটি ট্যাক্সিওয়ে নির্মাণের কারণ, রানওয়েতে উড়োজাহাজ বেশি সময় থাকার কারণে ওপর থেকে আরেকটি উড়োজাহাজ নামতে পারে না। এ ছাড়া পণ্য আমদানি ও রপ্তানির জন্য দুটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আরও থাকবে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তিনতলা ভবন। সব মিলিয়ে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে চলছে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ।
বর্তমানে এ বিমানবন্দরে গাড়ি পার্কিং একটি বড় সমস্যা। নতুন টার্মিনালে থাকবে একসঙ্গে ১ হাজার ৩০০ গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে এখন বছরে সক্ষমতা আছে ৮০ লাখ যাত্রীর সেবা দেওয়ার। তৃতীয় টার্মিনালের কাজ শেষ হলে সেটি উন্নীত হবে ২ কোটিতে। অর্থাৎ বাড়তি ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রী নতুন করে সেবার আওতায় আসবেন।
প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, মেট্রোরেল ১-এর পথ হচ্ছে কমলাপুর থেকে শুরু হয়ে রাজারবাগ-মালিবাগ-রামপুরা, যমুনা ফিউচার পার্ক, খিলক্ষেত হয়ে বিমানবন্দর পর্যন্ত। এটি পুরোটাই পাতালরেল। কাওলা স্টেশন থেকে ২০০ মিটারের একটি সুড়ঙ্গপথ তৈরির কাজ চলছে এখন। একই সঙ্গে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টার্মিনালে নামার জন্য সুড়ঙ্গ নির্মাণের কাজও চলছে। তবে নতুন টার্মিনালটি যদি পাতালরেলের আগে উদ্বোধন হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে যাত্রীরা সরাসরি টার্মিনালে চলে আসবেন।
টার্মিনালে ঢুকেই যাতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে না হয়, সে জন্য থাকছে ১১৫টি চেক ইন কাউন্টার। চেক ইন পর্ব শেষ করা হলেই ইমিগ্রেশন। তৃতীয় টার্মিনালে নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ। যেটি সংযুক্ত থাকবে উড়োজাহাজের সঙ্গে। বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার তৈরি করা হচ্ছে ৬৪টি। একই সঙ্গে আগমনী ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকবে ৬৪টি। আপনার লাগেজ বা ব্যাগ টানার জন্য নির্মাণ করা হবে ১৬টি কনভেয়ার বেল্ট।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, তৃতীয় টার্মিনালে মোট ৩৭টি অ্যাপ্রোন পার্কিং থাকবে। অর্থাৎ এক সঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করতে পারবে। এখন ২৯টি অ্যাপ্রোন পার্কের সুবিধা আছে। শাহজালাল বিমানবন্দরে এখন চারটি ট্যাক্সিওয়ে আছে। নতুন করে আরও দুটি ট্যাক্সিওয়ে যোগ হচ্ছে। রানওয়েতে উড়োজাহাজকে যাতে বেশিক্ষণ থাকতে না হয়, সে জন্য নতুন দুটি ট্যাক্সিওয়ে তৈরি করা হচ্ছে।
৯ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে দেখা যায়, দেশের প্রধান বিমানবন্দর ঘিরে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। খন নির্মাণ করা হচ্ছে সীমানাদেয়াল, গার্ডরুম। সার্ভিস সড়ক নির্মাণের কাজও চলমান। নতুন টার্মিনালের প্রকল্প পরিচালক মাকসুদুল ইসলাম জানান, পুরো প্রকল্পে অন্তত ৫ হাজার মানুষ কাজ করছে। প্রকল্প এলাকায় কথা হলো শ্রমিক শাহ আলমের সঙ্গে। নোয়াখালীর বাসিন্দা শাহ আলম তিন মাস আগে এ প্রকল্পের কাজে যোগ দেন। আরও একাধিক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্প এলাকায় শ্রমিকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
২৭ হাজার বর্গমিটার এলাকা নিয়ে তৈরি হচ্ছে আমদানি কার্গো টার্মিনাল। পাইলিংয়ের কাজ শেষ। এখন চলছে গ্রাউন্ডের কাজ। ইমপোর্ট কার্গো টার্মিনালের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী এনামুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ৩৮৯টি পিলার বসানোর কাজ শেষ। পণ্য পরিবহন পুরোটাই হবে অটোমেশন পদ্ধতিতে।
প্রকল্প পরিচালক মাকসুদুল ইসলাম জানালেন, বিদেশ থেকে একজন যাত্রী হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই যাতে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা পান, তৃতীয় টার্মিনালটি সেভাবেই তৈরি করা হচ্ছে। সব ধরনের সুবিধা থাকবে এ টার্মিনালে।