>বিদায়ী ২০১৯–এর শুরুটা ভালো ছিল, শেষটা তেমন ভালো হলো না। শুরুতে ছিল অনেক প্রতিশ্রুতি, শেষটা ছিল অনেক ক্ষেত্রেই আশাভঙ্গের। কারণ, চাপের মুখে আছে অর্থনীতি। অর্থনীতির সঙ্গে যাঁরা নানাভাবে সম্পর্কিত, তাঁরা কীভাবে দেখছেন দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে। কেমন গেল বিদায়ী বছরটি। অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো কী কী। তাহলে নতুন বছরে যাচ্ছি কী নিয়ে, প্রত্যাশাগুলো কী। ঠিক এই প্রশ্নগুলোই রাখা হয়েছিল দেশের বিশিষ্ট কয়েকজন অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে। তাঁরা অর্থনীতির মূল্যায়ন যেমন করেছেন, তেমনি বলেছেন কী তাঁরা চান, কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে অর্থনীতি।
কেমন গেল
এই বছরে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। আমরা অনেকেই আশা করেছিলাম, এই সরকার নতুন উৎসাহ ও নতুন উদ্দীপনা নিয়ে এমন কিছু পদক্ষেপ নেবে বা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করবে, যাতে ব্যক্তি খাতে নতুন বিনিয়োগ ত্বরান্বিত হবে; কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তা ঘটেনি। শুধু তা-ই নয়, ব্যক্তি উদ্যোগে মূলধন জোগায় যে পুঁজিবাজার এবং ঋণ জোগায় যে ব্যাংকিং খাত, সেই দুই জায়গাতেই এ বছর বড় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। নতুন সরকার যে ব্যবস্থা নিল, তাতে এর কাঠামোগত সমস্যা আরও গভীর হলো। একদিকে স্মরণাতীতকালের মধ্যে পুঁজিবাজারের সূচক সবচেয়ে নিচে নেমে গেল, অন্যদিকে ব্যাংকের সুদহার কমানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর মন্দ ঋণ আরও বেড়ে গেল।
বছরের শেষ নাগাদ আমরা দেখছি, সংস্কারের সমস্যা তো রয়েই গেল, উপরন্তু সংস্কারের অভাবের কারণে আরও সমস্যা সৃষ্টি হলো। এখন আর ব্যাংক, পুঁজিবাজার বা বিনিয়োগই সমস্যা নয়, রাজস্ব আদায়ের দুর্বলতা ও রপ্তানি কমে যাওয়াও সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি ১০ বছরের মধ্যে রপ্তানি আয় এই প্রথম নেতিবাচক হয়ে গেছে। কৃষকও ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে পুঁজি পাচার আরও বেগবান হয়েছে। একমাত্র আশার আলো হচ্ছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। যদিও আমরা জানি, এটি বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত, তাই মধ্য মেয়াদে এর ওপর আস্থা রাখা কঠিন।
এই অবস্থায় বলা যায়, বাংলাদেশ খুব শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ২০১৯ সাল শেষ করছে না। বছরটা শুরু হয়েছিল যেভাবে, শেষ হচ্ছে তারচেয়ে দুর্বলভাবে। তাই সামগ্রিকভাবে আগামী বছর অর্থনীতির পথটা অমসৃণ হবে বলেই মনে হচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ
২০২০ সালের প্রধান চ্যালেঞ্জই হলো রাজস্ব আদায়। রাজস্ব আদায় না হলে এ-সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা অর্থনীতিকে আক্রান্ত করবে। অর্থাৎ, রাজস্ব আদায় না হলে সরকার কোত্থেকে ব্যয় করবে, সেই ব্যয়ের গুণগত মান, সেই ব্যয় নির্বাহ করতে ঋণ নেওয়া, এর ফলে টাকার মূল্যমান কী হবে, সুদের হার কী হবে, মূল্যস্ফীতি কেমন হবে—এ রকম হাজারো সমস্যা রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো, রপ্তানির নেতিবাচক ধারা ঘোরানো না গেলে এর প্রভাব কেবল অর্থনীতির মধ্যে সীমিত থাকবে না। বড় বড় কিছু কলকারখানা যদি বন্ধ হয়ে যায় এবং হাজার হাজার শ্রমিক মাঠে নামেন, তাহলে দেশের কী পরিস্থিতি হবে, তা বলাই বাহুল্য। এই রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে আরও অনেক বিষয় জড়িত। যেমন টাকার মূল্যমান কী হবে।
অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল রাখার সক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কমে যাচ্ছে কি না, তা-ও আরেক উদ্বেগের বিষয়। আবার সরকার বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে সামঞ্জস্য না এনে প্রবাসী আয়ে ২ টাকা করে প্রণোদনা দেওয়ার প্রাগৈতিহাসিক ব্যবস্থা নিয়েছে। এটা পশ্চাৎমুখী ব্যবস্থা এবং এতে অপচয় হয়। এর সঙ্গে আবার রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ, পুঁজিবাজারে বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্পর্ক আছে। তাই বৈদেশিক খাতকে কেন্দ্র করে সমস্যা হতে পারে।
তৃতীয় চ্যালেঞ্জটি হলো, বড় বড় প্রকল্পগুলো স্থিতিশীলতা ও পরিপূর্ণতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা। দেশের বর্তমান উন্নয়নের ধারা অতিমাত্রায় ভৌত অবকাঠামোভিত্তিক। ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো যায়নি। মধ্যম আয়ের দেশের জন্য যে পরিপূরক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠার কথা ছিল, তা হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে অবকাঠামোর ব্যয় যে হারে বেড়েছে, তাতে সরকারের দায়দেনা পরিস্থিতির কিঞ্চিৎ অবনতি হয়েছে। আরও কিছু স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার কারণেও পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।
তিন প্রত্যাশা
অন্যদিকে তিনটি প্রত্যাশা করার সাহস নেই। আশা একটাই। ব্যাপারটা হলো, দেশের অগ্রসরমাণ অর্থনীতির শ্লথ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি শ্লথ হয়ে গেছে। ভারতেও সেই ধারা দেখা যাচ্ছে। সমস্যাটা কাঠামোগত। সংস্কারের অভাবের কারণে যারা সবচেয়ে লাভবান হচ্ছে, যারা কর ফাঁকি দিয়ে, টাকা পাচার করে, ঋণ ফেরত না দিয়ে লাভবান হচ্ছে, পুঁজিবাজারে ফাটকাবাজি করে লাভবান হচ্ছে, এদের হাত থেকে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া মুক্ত করতে হবে।
আমি প্রত্যাশা করি, ২০২০ সালে এই কাজ করার মতো রাজনৈতিক শক্তি, দৃঢ়তা ও প্রজ্ঞা দেখতে পাব। নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন যে একটি শ্রেণির হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে, তা থেকে বেরোনো না গেলে নির্বাচনী ইশতেহার যেমন বাস্তবায়ন করা যাবে না, তেমনি প্রবৃদ্ধির ধারা টেকসই করা যাবে না। পিছিয়ে পড়া মানুষকে সামনে নিয়ে আসতে এর বিকল্প নেই।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
বিশেষ ফেলো
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ