টাকার সহজ লেনদেনের পথদ্রষ্টা

বিকাশের প্রধান িনর্বাহী কামাল কাদীর
ছবি: সাজিদ হোসেন

মাত্র এক দশকের যাত্রায় মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান বিকাশকে শীর্ষস্থানীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন কামাল কাদীর। সময়ের ব্যবধানে বিকাশ ও কামাল কাদীর পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। বিকাশ ও বাংলাদেশের মোবাইল আর্থিক খাতের যাত্রাপথ সমান্তরাল। এ কারণেই সাধারণ মানুষের কাছে মোবাইলে আর্থিক সেবার সমার্থক শব্দতে পরিণত হয়েছে ‘বিকাশ’।

উদ্যোক্তা হিসেবে পথযাত্রা সহজ ছিল না। কামাল কাদীরের মতে, যেকোনো স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মের তরুণ, যুবক কিংবা মধ্যবয়সীদের মতো তাঁর জীবন একটা খোলা খাতা। জীবনের প্রতিটি অধ্যায় থেকে শিক্ষা নিয়েছেন, ভুল করেছেন, উদ্যোগ নিয়েছেন, ঝুঁকি নিয়েছেন—এভাবেই ঋদ্ধ হয়েছেন, হয়েছেন সমৃদ্ধ।

স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মের একেকজন উদ্যোক্তা যেভাবে নিজেদের মতো করে বিকশিত হয়েছেন, কামাল কাদীরের উদ্যোক্তা হওয়ার ইতিহাসটাও ঠিক তা–ই। শৈশবে বাবাকে হারালেও ষাটের দশকে স্বাধিকার রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় আইনজীবী বাবার রেখে যাওয়া দর্শন তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে। বড় হয়েছেন স্বাধীন দেশে কিছু করতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। এ কারণে চারুকলা ও অর্থনীতিতে বিদেশে গিয়ে শিক্ষা নিয়ে দেশে প্রথম ফিরেছিলেন নিজের চিত্র প্রদর্শনী করতে। এরপর জ্বালানি খাতের একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে শীর্ষস্থানীয় পদে কাজ করার সুবাদে দেশের অর্থনীতিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। পরে বড় ভাইয়ের সঙ্গে একটি অ্যানিমেশন স্টুডিও গড়তে উদ্যোগ নেন। তাতে সফল না হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমআইটিতে যান। তারপর আবার দেশে ফিরে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করেন।

কামাল কাদীর বলেন, প্রতিটি পর্বেই উপযুক্ত পথপ্রদর্শকের কাছে তিনি শিক্ষা পেয়েছেন। মার্কিন মুলুকে করপোরেটের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার কারণে করপোরেট সুশাসনের গুরুত্বটা শুরু থেকেই জানতেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে সেলবাজার নামে পণ্য কেনাবেচার মোবাইলভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সেবা চালু করেন। এবারের যাত্রায় বিচিত্র কর্মপরিবেশের পাশাপাশি নানা ধরনের মানুষ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, ডিজিটালাইজেশন ও নিত্যনতুন উদ্ভাবনের সঙ্গে পরিচিত হন।

সেলবাজার পরিচালনার সময় ডিজিটাল পেমেন্টের ঘাটতির বিষয়টি অনুধাবন করেন কামাল কাদীর। তখন কেনিয়ায় সবে মোবাইল আর্থিক সেবা খাতের যাত্রা শুরু হয়েছে। মোবাইল আর্থিক সেবা খাত সম্পর্কে হাতে-কলমে বুঝতে কেনিয়ায় যান তিনি। এর আগে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি উৎসাহ দিয়ে ব্র্যাককে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে বলছিলেন। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার দিকনির্দেশনাও তত দিনে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২০১০ সালে লাইসেন্স পেয়ে বিকাশের পথচলা শুরু হয় ২০১১ সালে। যাত্রা শুরুর পর থেকে মোবাইল আর্থিক সেবাকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিতি করে তোলে বিকাশ। এক দশকের পথযাত্রায় বিকাশ পরিবারে গ্রাহক হিসেবে যুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ।

একনজরে

বিকাশ

প্রতিষ্ঠা

লাইসেন্সপ্রাপ্তি

১২ এপ্রিল ২০১০

সেবার যাত্রা শুরু

২১ জুলাই ২০১১

কর্মী

২০০০+

হিসাবসংখ্যা (ব্যক্তিগত) ২০১৯ সাল

প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ

২০২০ সাল

৫ কোটি

২০২১ সাল

প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ (সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত)

বাণিজ্যিক হিসাবসংখ্যা ২০১৯ সাল

১ লাখ

২০২০ সাল

১ লাখ ৮০ হাজার

২০২১ সাল

২ লাখ ৬৫ হাজার

কখন বেশি লেনদেন (দিনের কোন সময়ে)

সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৮টা

কোন তিন জেলার মানুষ বেশি লেনদেন করেন

ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর

টাকা পাঠানো ও তোলাসংক্রান্ত সেন্ড মানি, ক্যাশ আউট, ক্যাশ ইন দিয়ে শুরু করে এক দশকের যাত্রায় বিকাশ মোবাইল রিচার্জ, পরিশোধ, ব্যাংক থেকে বিকাশে টাকা যুক্ত করা (অ্যাড মানি, বিকাশ থেকে ব্যাংকে অর্থ প্রেরণ (ট্রান্সফার মানি), ব্যাংকের ক্ষুদ্র ডিজিটাল ঋণ বিতরণ, প্রবাসীদের পাঠানো আয় বা রেমিট্যান্স, বিভিন্ন ইউটিলিটি সেবার বিল দেওয়া, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাসিক সঞ্চয়সহ একের পর এক নতুন সেবা চালু করেছে। সেবার বৈচিত্র্য ও বিস্তারে প্রতিনিয়ত প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা নিয়ে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে চলেছে বিকাশ। ১০ বছরে ২৯টি প্রতিষ্ঠান এমএফএস পরিচালনার জন্য লাইসেন্স নিলেও সেবার মান ও ব্যাপ্তিতে সবার ওপরে বিকাশ।

বিকাশের এই সাফল্যের রহস্য কী? কামাল কাদীর বলেন, ‘প্রথমত আর্থিক অন্তর্ভুক্তির দিকে সরকারের সুস্পষ্ট দৃষ্টি ছিল। সবকিছু ডিজিটাল পদ্ধতির মধ্যে আনার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল। এরপর বলতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা। তাদের নীতিকাঠামো এবং প্রয়োজনমাফিক তা পরিবর্ধন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে কাজটি সহজ হয়েছে।’ অনেক সময় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নানামুখী উদ্যোগ ও নিয়ন্ত্রণ থাকায় বেসরকারি উদ্যোগের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়। তবে কামাল কাদীরের মতে, এমএফএসের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা সব সময়ই ইতিবাচক ছিল। এ ছাড়া নতুন উদ্ভাবন ও পরামর্শ ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করাটাও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বিকাশের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি রয়েছেন। মূলধন অংশীদারত্বের মাধ্যমে বিকাশের সঙ্গে যুক্ত আছে ব্র্যাক ব্যাংক, মানি ইন মোশন এলএলসি, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, বিশ্বব্যাংকের আইএফসি, আলিবাবা গ্রুপের অ্যান্ট ফিন্যান্সিয়ালের মতো আন্তর্জাতিক ও দেশি প্রতিষ্ঠান। তারা শুধু পুঁজি নিয়েই আসেনি, নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি দিয়েও বিকাশকে সমৃদ্ধ করেছে।

কামাল কাদীর দেশের মেধার ওপর অগাধ বিশ্বাস রাখেন। তাঁর সেই বিশ্বাস থেকেই কেবল দেশীয় প্রযুক্তিবিদ ও পেশাজীবীদের নিয়োগ দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিয়েলসনের সাম্প্রতিক জরিপে বিকাশ বর্তমান বাংলাদেশি তরুণ ও তরুণীদের জন্য সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত চাকরির জায়গা হিসেবে উঠে এসেছে। সাফল্য বিবেচনায় অন্যান্য এমএফএসের তুলনায় বিকাশ বেশ এগিয়ে রয়েছে। কামাল কাদীরের মতে, তাদের একটি বড় শক্তির জায়গা হলো ব্যবসার ধরনে একমুখিতা। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বিকাশ শুধু মোবাইল আর্থিক সেবা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই এগিয়েছে। এ ছাড়া সঠিক ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, দেশব্যাপী এজেন্ট নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, গুণগত মানের গ্রাহক সেবা নিশ্চিতকরণ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিধিবিধান মেনে চলা, জবাবদিহির অনুশীলন, সঠিক মানবসম্পদ এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বিকাশকে এগিয়ে নিয়েছে।

যেকোনো ব্যবসায় শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান তাদের কর্তৃত্বপূর্ণ অবস্থান নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের প্রবণতা থাকে। ফলে বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কামাল কাদীর বলেন, তাঁরা এ ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন। কখনোই এমন কোনো উদ্যোগ তাঁরা নেন না, যা অন্যদের ওপর অন্যায্য প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, বিকাশ এজেন্ট নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। লাখ লাখ এজেন্টকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। বিকাশ তার এজেন্ট নেটওয়ার্ক উন্মুক্ত রেখেছে। সে কারণে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানও বিকাশ এজেন্টদের সঙ্গে কাজ করতে পারছে।

আগামী দিনের বিকাশ কেমন হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে কামাল কাদীর বলেন, বর্তমানের ভিত্তি ও আগামীর চাহিদা এবং এখনো না পারা উদ্যোগের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। আগামী দিনের নিরিখে বিকাশের গবেষণা সেল কাজ করছে। দেশের সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন সেবাটি এখনো যারা পায়নি, তাদের কাছে বিকাশের সেবা পৌঁছে দিতে চান তিনি। এখন দেশের যেকোনো জায়গায় মানুষ তার হাঁটা পথে বিকাশ এজেন্টের দেখা পান। তাঁর প্রত্যাশা, ভবিষ্যতে সব ধরনের আর্থিক লেনদেন বিকাশের মাধ্যমে করার সুযোগ তৈরি করা। ব্যাংক ও সেবাগ্রহীতার মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার যে কাজটিও ইতিমধ্যে শুরু করেছে বিকাশ, তা আরও সম্প্রসারিত করতে চান।

কামাল কাদীর মনে করেন, বিকাশ ১০ বছর পার করলেও যাত্রাপথের মাঝরাস্তায় রয়েছে। এখনো বহুদূর চলা বাকি। আরও অনেক সেবা দেওয়ার বাকি। তাঁর মতে, অনেক কিছু একসঙ্গে না করে একটি জিনিসকে ভালোভাবে করলেই সাফল্য ধরা দেবে। কামালের ইচ্ছা, বিকাশের হাত ধরে আরও কাজ করবেন হাটে, মাঠে, ঘাটে, গ্রামে, গঞ্জে, শহরে বা বিদেশে। তিনি এ জীবন নিয়ে আনন্দিত। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী।

আমার মন বলছে, নিশ্চিত কামাল কাদীর যেখানে হাত দেবেন, সেখানেই সাফল্য আসবে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: গবেষণা পরিচালক, সিপিডি