• বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি।
• ২০১১ সালে বাচ্চুর অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
• অর্থ মন্ত্রণালয়কে তা জানালেও ব্যবস্থা নেয়নি।
• দুদকও চুপ ছিল।
বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর অনিয়ম-দুর্নীতির কথা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক—কারোরই অজানা ছিল না। কিন্তু দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাঁকে প্রশ্রয় দিয়েছে এবং রহস্যজনক কারণে সমীহ করেছে।
প্রথম দফায় ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিন বছরের জন্য চেয়ারম্যান হয়েই আবদুল হাই অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন। তাঁর প্রথম অপকীর্তি ২০১০ সালের শুরুতেই। সেটা হচ্ছে ব্যাংকের জন্য ভবন কেনার নামে। সিঙ্কু আকরামুজ্জামান নামের একজনের সঙ্গে ৮০ কোটি টাকার চুক্তি করেন এবং চুক্তির দিনই তাঁকে ৪০ কোটি টাকা নগদ দিয়ে দেওয়া হয়। বাকি টাকা ব্যাংক পরে দেয়। টাকা নিয়ে ওই ব্যক্তি মালয়েশিয়ায় চলে যান। বেসিক ব্যাংক এখনো সেই ভবন বুঝে পায়নি।
এভাবে একের পর এক অনিয়মে একটানা পাঁচ বছরে ব্যাংকটিকে প্রায় শেষ করে দেন আবদুল হাই। ২০১৪ সালের আগস্টে ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্তের দুই দিন আগে শুক্রবার ছুটির দিনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাসায় গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন আবদুল হাই। আর এভাবেই সরকার ‘সম্মানের’ সঙ্গে তাঁকে বিদায়ের সুযোগ করে নেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১১ সালেই আবদুল হাইয়ের দুর্নীতির প্রমাণ পায় এবং ২০১২ সালে শান্তিনগর, গুলশান ও দিলকুশা শাখা পরিদর্শন শেষে একটি প্রতিবেদন পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। অর্থ মন্ত্রণালয় তখন নীরব থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ২০১৪ সালে আবদুল হাইয়ের কোন ব্যাংক হিসাবে কত টাকা, কীভাবে জমা হয়, তার বিবরণও দুদককে জানিয়েছিল। কিন্তু দুদক তা আমলে নেয়নি। তবে আদালতের পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে আবদুল হাইসহ পর্ষদ সদস্যদের এখন জিজ্ঞাসাবাদ করছে দুদক।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা থেমে ছিলাম না। আদালতের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আবদুল হাইসহ পর্ষদ সদস্যদের নোটিশ পাঠানোর ঘটনা দৈবক্রমে মিলে গেছে।’
দুদকের প্রশ্রয়
বিএফআইইউর তদন্তে ২০১৪ সালে বেরিয়ে আসে যে লুটপাট হওয়া টাকার ভাগ সরাসরি নিয়েছেন আবদুল হাই এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা। ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় তিনি ইডেন ফিশারিজ লিমিটেড নামের একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন। এ প্রতিষ্ঠানের নামে মাত্র ১১ মাসে ব্যাংকে জমা হয় ১৩ কোটি টাকার বেশি।
এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণের টাকার অংশ সরাসরি জমা হয় আবদুল হাই ও তাঁর ভাই শাহরিয়ার পান্নার ব্যাংক হিসাবে। যেমন ব্যাংকটির গুলশান শাখা থেকে এশিয়ান ফুড ট্রেডিংকে ৭৯ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। ঋণ পেয়েই গ্রাহক টাকার একটা অংশ জমা করেন আবদুল হাইয়ের ব্যাংক হিসাবে, আরেকটা অংশ জমা করেন আবদুল হাইয়ের ভাই শেখ শাহরিয়ার ওরফে পান্নার হিসাবে।
জানতে চাইলে কোম্পানি আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবী তানজীব-উল-আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো গ্রাহকের টাকা থেকে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের হিসাবে টাকা স্থানান্তর হলে এটাকে ঘুষ হিসাবে ধরে নেওয়া যায়। এ জন্য দণ্ডবিধির ১৬১ ধারা অনুযায়ী তিন বছরের জেল হওয়ার বিধান রয়েছে।’
জানা গেছে, ২০১৩ সালের শুরুতে দুদক তদন্ত শুরু করেও পরে থেমে যায়। তখন দুদক চেয়ারম্যান ছিলেন গোলাম রহমান। পরে সংস্থাটির চেয়ারম্যান হয়ে আসেন এম বদিউজ্জামান এবং কয়েক মাস ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন মো. সাহাবুদ্দিন ওরফে চুপ্পু। বদিউজ্জামান ও সাহাবুদ্দিনের সময়েই পর্ষদ সদস্যরা বিশেষ আনুকূল্য পান।
সাহাবুদ্দিন বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান। জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটা প্রতিবেদন দিয়েছিল। সেটা একজন মহাপরিচালককে দেওয়া হয়েছিল। এরপর কী হয়েছিল জানা নেই।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আনুকূল্য
২০১২ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের ২ মার্চ সময়ে মাত্র ১১টি সভায় ৩ হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ঋণ অনুমোদন দেয় আবদুল হাইয়ের নেতৃত্বাধীন পর্ষদ। অনিয়মের তথ্য পেয়ে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির এমডি কাজী ফখরুল ইসলামসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সতর্ক করেন তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি।
অনিয়ম নিয়ে যখন বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি চালাচালির সময়েই চেয়ারম্যান হিসাবে তঁার মেয়াদ দুই বছর বাড়ায় সরকার।
যোগাযোগ করলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তখন এ বিভাগের সচিব ছিলেন না, তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না। ওই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ছিলেন আসলাম আলম, বর্তমানে যিনি বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের রেক্টর।
তৎকালীন সচিব আসলাম আলমের কাছে ২০১৩ সালের ১১ জুলাই বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন পর্ষদের সদস্য এ কে এম রেজাউর রহমান ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে চিঠি দিয়েছিলেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দরদ
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসিক ব্যাংককে আইনকানুন মানার পরামর্শ দিয়ে আসছিল নরম সুরে। পাশাপাশি দরদও দেখিয়ে আসছিল ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রতি। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে তখন আলোচনা চলছিল বেসিক ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগের। কিন্তু সরকারের উঁচু পর্যায়ের ইঙ্গিতের অপেক্ষায় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর সে পথে যায়নি। পরে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ব্যাংকটির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও ব্যাংকটির অনিয়ম রোধ হয়নি।
অর্থমন্ত্রী ২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও এমডিদের নিয়ে এক বিশেষ সভা করেন। সেই সভায় আবদুল হাই উপস্থিত হননি। সেই সভায় তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান নমনীয়ভাবে অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেন।
ব্যাংকের এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে (বর্তমানে পলাতক) ২০১৪ সালের ২৫ মে অপসারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ না ছাপানোর জন্য বিভিন্ন সরকারি সংস্থাও তখন সংবাদপত্রগুলোকে প্রভাবিত করেছে। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্ষদ সদস্যরা যেসব অপরাধ করেছেন বলে মনে হচ্ছে, তাতে দণ্ডবিধি অনুযায়ী তিন বছর এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী তাঁদের সাত বছরের জেল হওয়ার সুযোগ আছে।’
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি
২০০৯
৬ সেপ্টেম্বর ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু
২০১০
ভবন কেনার নামে অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু
২০১১
অস্তিত্বহীন কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া শুরু
২০১২
এপ্রিল থেকে মাত্র ৯ মাসেই অনিয়মের ৩,৪৯৩ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন
২০১২
৫ সেপ্টেম্বর চেয়ারম্যান হিসেবে পুনর্নিয়োগ
২০১২
৬ সেপ্টেম্বর অনিয়মের জন্য এমডিকে ডেকে সতর্ক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
২০১৩
১৭ জুলাই ব্যাংকটির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমঝোতা চুক্তি
২০১৩
১৮ আগস্ট চেয়ারম্যান-এমডিদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বৈঠক, আবদুল হাই অনুপস্থিত
২০১৩
২৭ নভেম্বর ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষক নিয়োগ
২০১৪
২৫ মে এমডি ফখরুল ইসলামকে অপসারণ
২০১৪
২৮ মে পর্ষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে গভর্নরের চিঠি
২০১৪
৪ জুলাই আবদুল হাইয়ের পদত্যাগ
২০১৫
সেপ্টেম্বর বিভিন্ন থানায় ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
২০১৬
জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১৬ জন গ্রেপ্তার
২০১৭
২৬ জুলাই পর্ষদ সদস্যদের শুনানি নিয়ে ৬০ দিনের মধ্যে তদন্তের নির্দেশ আদালতের
২০১৭
৪ ও ৬ ডিসেম্বর দুদকেআবদুল হাইয়ের শুনানি, পর্ষদের অন্যদেরও শুনানি
২০১৮
৮ জানুয়ারি আবদুল হাইয়ের তৃতীয় দফা শুনানি