আশির দশকের শেষ ভাগের কথা। পড়াশোনার জন্য আসি ঢাকায়। মা-বাবা ২০০ কিলোমিটার দূরের সরিষাবাড়ীতে। যোগাযোগ সপ্তাহে বড়জোর এক দিন, চিঠির মাধ্যমে। কলেজের খরচ ডাকঘরের ‘মানি অর্ডার’-এর মাধ্যমে। সেও সরিষাবাড়ী থেকে পাঠালে ঢাকা পৌঁছাতে সাত দিন বা আরও বেশি সময়। খুব জরুরি কিছু হলে টেলিফোন। ট্রাংক কলের যুগ শেষ হয়ে তখন নেশন ওয়াইড ডায়ালিং সবে শুরু হয়েছে, তবে সব উপজেলায় নয়।
এক দশক পরের কথা। বাংলাদেশে কম্পিউটারের সত্যিকারের জাগরণ যেন শুরু হলো। ১৯৯৭ সালে হাতের মুঠোয় এল মুঠোফোন। ঢাকার বাইরেও গেল। পল্লীফোনের কর্মীদের ফোন দিয়ে বললে বাড়িতে তিনি যেতেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলা যেত। এটুকুতেই তখন বিস্ময়। এই দশকেই অনলাইন ইন্টারনেটের স্বাদ পেলাম আমরা। অনেকেরই মনে আছে, মডেম নামের এক যন্ত্র ছিল, বাসার টেলিফোন সংযোগের তার খুলে সেটা লাগাতে হতো সেই যন্ত্রে। তারপর কিছুক্ষণ যান্ত্রিক শব্দের পর যুক্ত হতাম ইন্টারনেটে। ই-মেইল যখন নামত, তখনও সময় লাগত।
নতুন সহস্রাব্দে এসে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ শুরু হলো সর্বত্র। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এল, এল স্মার্টফোন। বিশ্বব্যাপী অন্তর্জালের যে ব্যাপ্তি, সেখানে ইয়াহু, জিমেইল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ইত্যাদি সব ডিজিটাল উদ্ভাবনী উদ্যোগ বিশ্বকেই যেন পাল্টে দিল রাতারাতি। আর সেই ধারা চলছে এখনো। একটা সময় বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবের, শেখ কিংবা ইস্পাত বা খনিশিল্পের মালিকদের স্থান হতো। সেই স্থান এখন অনেক বছর হলো বিল গেটস, মাইকেল ডেল, মার্ক জাকারবার্গের দখলে। তাঁদের সম্পদ কিংবা অর্থের উৎস স্রেফ তাঁদের মস্তিষ্ক।
এখন এই সময়ে এসে প্রযুক্তির ব্যবহার সব জায়গাতেই। নতুন প্রযুক্তি বাজারে আসার পর, তা বাংলাদেশেও চলে। সফটওয়্যার বা ওয়েবভিত্তিক সেবা তো বটেই, যন্ত্রপাতিও চলে আসে প্রায় কাছাকাছি সময়। হাতের মুঠোয় আশ্চর্য এক যন্ত্র, স্মার্টফোন। সেই যন্ত্র দিয়ে চাইলেই ডাকা যায় ট্যাক্সি কিংবা বাইক, অর্ডার করা যায় খাবারের, অ্যাপ দিয়েই ঠিক করা যায় হোটেল-রিসোর্ট, বিমানসহ প্রায় সব পরিবহনের টিকিট। অনলাইনে বিল পরিশোধ, টাকা আদান-প্রদান—সবই তো এখন নিমেষের ব্যাপার মাত্র। প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের জীবনে ঢুকে যাওয়ার জন্য উদ্ভাবনের কমতি নেই। এ ধারা বাংলাদেশেও প্রবল। ফলে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেগবান। অবস্থা দিনকে দিন উন্নত হচ্ছে।
এগিয়ে চলা
সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তিসেবা খাত থেকে সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানি বেড়েছে। দেশে সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তিসেবা খাতের রপ্তানি সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের তথ্য মতে ২০১৮–১৯ অর্থবছরে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। যা টাকার হিসেবে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। দেশের অভ্যন্তরীণ সফটওয়্যারের বাজারও বড় হচ্ছে। দেশের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকায়। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই আবার দেশি সফটওয়্যার নির্মাতারা দখল করেছেন। দেশের ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে ২৭টি ব্যাংকেই দেশি সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, ‘দেশের বাজারে চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এখন আমাদের সফটওয়্যার নির্মাতারা বিদেশেও রপ্তানি করছে। দেশের এক দশকের অর্জনে আমরা গর্বিত। আমাদের লক্ষ্য আরও বেশি দূর যাওয়া।’
বর্তমানে সফটওয়্যার খাতের যেসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ওয়েবসাইট তৈরি ও ডিজাইন, মোবাইল অ্যাপ, গেমস, অ্যাপ্লিকেশন প্ল্যাটফর্ম, ভিওআইপি অ্যাপ্লিকেশন, ডেটা এন্ট্রি, গ্রাফিক ডিজাইন, প্রি-প্রেস, ডিজিটাল ডিজাইন, সাপোর্ট সেবা, কাস্টমাইজড অ্যাপ্লিকেশন তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি।
চলতি সহস্রাব্দের শুরু থেকেই আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং শব্দগুলো পরিচিত হতে থাকে। বাংলাদেশ এখন ফ্রিল্যান্সিং আউটসোর্সিংয়ে একটি বড় নাম। এ কাজে এখন জড়িত প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষ।
উদ্ভাবনে নিরন্তর বদলে যাওয়া
নতুন সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন দশক। এখন বাংলাদেশেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), রোবটবিজ্ঞান, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), বিগডেটা পরিচিত প্রযুক্তি। শুধু পরিচিতই বা বলি কেন, এসবের উদ্ভাবন বা প্রয়োগেই আমরা এগিয়ে চলেছি। দেশে স্মার্টফোনসহ নানা প্রযুক্তিপণ্য তৈরি হচ্ছে, রপ্তানিও হচ্ছে।
নতুন দশককে বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দশক। এর চ্যালেঞ্জ সামলাতে প্রস্তুত আমাদের সফটওয়্যার খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনটাই বলছেন বেসিসের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফারহানা এ রহমান। তিনি বলেন, বেসিস এ দশকের জন্য প্রস্তুত। নানা প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, ব্র্যান্ডিং, নেটওয়ার্কিংসহ যুগোপযোগী কার্যক্রম এই প্রস্তুতিকে আরও বেগবান করবে।
যে কথা বলছিলাম শুরুতে, ২০০ কিলোমিটার দূরে থাকা মা-বাবার সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ করতে লাগত কয়েক দিন। আর বছরখানেক আগে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে নিমেষেই কথা হলো তাঁদের সঙ্গে। শুধু কথা নয়, ভিডিওতে তাঁদের দেখা গেল। প্রযুক্তির উদ্ভাবনে সুবিধাই বেশি। কিন্তু এই সুযোগে প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধের প্রবণতাও কম নয়। অপব্যবহারও হয়ে থাকে হামেশাই। তথ্যপ্রযুক্তির আলোকেই গ্রহণ করব আমরা, অন্ধকারকে নয়।
ডিজিটাল প্রযুক্তির বড় বিষয় এর উদ্ভাবনী শক্তি। এই শক্তি রূপান্তর করেছে আমাদের জীবনযাপন। সহজ করতে পেরেছে দৈনন্দিন জীবনধারা। এ ধারা আরও বেগবান হবে। আর সে পথে আমাদের সফলতার সম্ভাবনা অপার।