বাণিজ্যযুদ্ধের কোপে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পোশাক রপ্তানি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। সেই ব্যবসা ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গেছে। ফলে বিদায়ী বছর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত বছর চীন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২ হাজার ৪৮৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে, যা ২০১৮ সালের চেয়ে ২৪৯ কোটি ডলার বা ৯ দশমিক ১০ শতাংশ কম। এমন দুরবস্থায় গত পাঁচ বছরের মধ্যে আর পড়েনি চীন। ২০১৮ সালেও ট্রাম্পের দেশে চীনের পোশাক রপ্তানি বেড়েছিল ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) দেওয়া পরিসংখ্যান থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। অটেক্সার তথ্যানুযায়ী চীনের পোশাক রপ্তানি কমলেও যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকেরা ব্যবসা কমায়নি। গত বছর তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৮ হাজার ৩৮২ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে, যা ২০১৮ সালের চেয়ে ১ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি।
অটেক্সার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চীনের ব্যবসা হারানোতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ভিয়েতনাম। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ পাঁচ পোশাক রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে তাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ। ভিয়েতনাম গত বছর ১ হাজার ৩৫৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। তারপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বাংলাদেশের। রপ্তানির পরিমাণ ৫৯৩ কোটি ১৯ লাখ ডলার। গত চার বছরের মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের। সর্বশেষ ২০১৫ সালে পোশাক রপ্তানিতে ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করেছিল বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ধাক্কা খায়। অনেক বিদেশি ক্রেতা তখন বাংলাদেশ থেকে তাদের কার্যক্রম গোটায়। সেটির প্রভাবে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে রপ্তানি কমে যায়। টানা ১৫ মাস ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির পর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাজারটিতে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ওই সময় চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে গেলে বাড়তি শুল্কের হাত থেকে নিস্তার পেতে অনেক মার্কিন ক্রেতা চীনের বিকল্প খুঁজতে শুরু করে। তাতে বাংলাদেশে পোশাকের বাড়তি ক্রয়াদেশ আসতে থাকে। সেটি এখনো অব্যাহত আছে বলে জানালেন কয়েকজন উদ্যোক্তা।
>বিদায়ী বছরে চীনের পোশাক রপ্তানি ৯ শতাংশ কমে গেলেও বাংলাদেশের বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ
বিষয়টি নিশ্চিত করে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি ক্রয়াদেশ আমরা পেয়েছি। তবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ভিয়েতনাম, ভারত, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ। তারা ডলারের বিপরীতে নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গেছে। আমরা সেটি করতে পারি না। ফলে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীনের হারানো ব্যবসা শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিতে পারছি না আমরা।’
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি মো. শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ক্রয়াদেশসংক্রান্ত নানা তথ্য আমাদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করছে। তবে তারা যে দাম দিতে চাচ্ছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের উৎপাদন খরচের চেয়ে কম। সে জন্য অনেক ক্রয়াদেশ ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। তবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের পোশাক রপ্তানি অনেক বৃদ্ধি পেত।’
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভালো করলেও সামগ্রিকভাবে পোশাকশিল্পের রপ্তানির অবস্থা খারাপ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী চলতি ২০১৯–২০ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে ১ হাজার ৯০৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ কম।
এদিকে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত লাভবান হয়েছে। বাজারটিতে গত বছর ভারত রপ্তানি করেছে ৪০৬ কোটি ডলারের পোশাক। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। তবে ভারতের থেকে বেশি রপ্তানি করেছে ইন্দোনেশিয়া, ৪৪০ কোটি ডলার। তাদের রপ্তানি কমেছে ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
রপ্তানির পরিমাণ এখনো তলানিতে থাকলেও বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে কপাল খুলেছে মিয়ানমারের। যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর ৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করছে দেশটি, যা ২০১৮ সালের চেয়ে ১৬০ শতাংশের বেশি। মিয়ানমার ভালো করলেও পাকিস্তান অবশ্য পারেনি। গত বছর ১৪৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে পাকিস্তান। তাদের রপ্তানি কমেছে ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ।