মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে রডের দাম বেড়েছে টনপ্রতি আট-নয় হাজার টাকা। তাতে বিপাকে পড়েছেন ব্যবহারকারীরা।
করোনা মহামারির শুরুতে সারা দেশে নির্মাণকাজ প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছিল। তাতে অন্যতম নির্মাণ উপকরণ রডের চাহিদাও ব্যাপক হারে কমে যায়। বিপাকে পড়ে তখন কোম্পানিগুলোও পণ্যটির দাম কমায়, যদিও চাহিদা ছিল কম। মহামারির ধাক্কা সামলে মাস দুয়েক আগে থেকে অনেকেই নির্মাণকাজে হাত দিতে শুরু করেন। সরকারি-বেসরকারি নানা প্রকল্পের কাজও পুরোদমে শুরু হয়। এতে চাহিদা বেড়ে যায়। এই সুযোগে গত ১৫ দিনে প্রতি টন রডের দাম ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা বাড়িয়ে দেয় কোম্পানিগুলো।
দাম বাড়ার কারণ হিসেবে উৎপাদকেরা বলছেন, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম দেড় মাসে টনপ্রতি ১০০ ডলার বেড়েছে। চাহিদানুযায়ী কাঁচামালও পাওয়া যাচ্ছে না। তবে দাম বাড়ার কারণ যেটাই হোক, তাতে কিন্তু কপাল পুড়েছে মূলত ব্যবহারকারীদের। কারণ, রডের ব্র্যান্ডভেদে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ দাম বেড়েছে। তাতে নির্মাণকাজের খরচ কয়েক শতাংশ বাড়বে।
চট্টগ্রাম নগরের ২ নম্বর গেট এলাকায় ‘নজরুল ট্রেডিং’ বিএসআরএম ও আবুল খায়ের কোম্পানির রড বিক্রি করছে। বৃহস্পতিবার সেখানে গেলে বিক্রেতা জানান, কোম্পানিগুলো দুই সপ্তাহ ধরে প্রতি টন রডের দাম কোনো দিন ৫০০ টাকা, কোনো দিন এক হাজার টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছে। এতে ভালো ব্র্যান্ডের রডের দাম টনপ্রতি ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা বেড়ে গেছে। বর্তমানে বিএসআরএম ব্র্যান্ডের রড প্রতি টন ৬৪-৬৫ হাজার টাকা এবং আবুল খায়ের ব্র্যান্ডের রড ৬২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করছে তারা।
যোগাযোগ করলে কয়েকজন ডিলার প্রথম আলোকে জানান, বাজারে এখন ভালো মানের (৬০ গ্রেডের ওপরে) রড ৬২ হাজার টাকার নিচে মিলছে না।
রডের দাম বাড়ায় যাঁরা বাড়ি নির্মাণকাজে হাত দেওয়ার কথা ভাবছেন, তাঁরা এখন বাড়তি ব্যয় নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন। এমনই একজন চট্টগ্রামের হালিশহরের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী ফয়েজ আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জানুয়ারিতে ফেনীর গ্রামের বাড়িতে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিয়েছি। মাত্র দুই টন কেনার পর নতুন করে কিনতে গিয়ে দেখি, দাম এক লাফে ৯ হাজার টাকা বেড়েছে। দাম বাড়ায় বাড়ি নির্মাণের খরচ বহুগুণ বেড়ে যাবে। কীভাবে নির্মাণকাজ শেষ করব, তা জানি না।’
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারেরাও বিপাকে পড়েছেন। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের নির্মাণ ঠিকাদার বুলবুল আহমেদ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের গাইডওয়ালসহ সড়ক ও সেতু নির্মাণের একটি প্রকল্পের কাজ করছেন। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুষ্টিয়ায় রডের দর এক লাফে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে নির্মাণকাজ বন্ধ করতে হয়েছে। অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি। কারণ, যেভাবে খরচ বেড়েছে, তাতে নিজের পকেট থেকে টাকা দিতে হবে।’
ক্রেতারা জানান, অক্টোবর থেকে রডের চাহিদা বাড়ছিল। নভেম্বরে নির্মাণকাজের চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় কোম্পানিগুলো রডের দাম বাড়িয়েছে। এতে অবশ্য নির্মাণকাজ কমে যাচ্ছে। যেমন ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার পুরাতন মুহুরীগঞ্জ
বাজারের মেসার্স এস এ ট্রেডার্সের কর্ণধার মো. শাহজাহান মোবাইল ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় বেচাবিক্রি প্রায়ই বন্ধ ছিল। শীত মৌসুম শুরু হওয়ার পর চাহিদা বাড়ছিল। তবে দাম বাড়ার পরপরই বেচাবিক্রি কমে গেছে। সবাই দাম কমার অপেক্ষায় আছেন।
উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো বলছে, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রড তৈরির কাঁচামাল পুরোনো লোহার টুকরার দাম ছিল প্রতি টন ৩০৭ ডলার। এখন তা বেড়ে ৪০৬-৪১০ ডলারে উঠেছে। সেই হিসাবে প্রতি টন কাঁচামালের দাম বেড়েছে প্রায় সাড়ে আট হাজার টাকা। আবার বিশ্বজুড়ে কনটেইনারের সংকটের কারণে এখন ঋণপত্র (এলসি) খুলেও সময়মতো পণ্য হাতে পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। এমন সংকটের সময়ে রপ্তানিকারক দেশ চীন এখন নিজেই আমদানি করছে। দুই বছরের আমদানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে তারা লোহা তৈরির কাঁচামাল পুরোনো লোহার টুকরা আমদানি করছে। এতে খাতটিতে আরও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
জানতে চাইলে দেশের শীর্ষস্থানীয় রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) তপন সেনগুপ্ত বলেন, করোনার আগে যদি রডের মূল্য তুলনা করা হয়, তাহলে টনপ্রতি দাম এক-দেড় হাজার টাকা বেড়েছে। রডের কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকায় কোম্পানিগুলো এখন মূল্য সমন্বয় করছে।
একই সুরে কথা বলেন রড উৎপাদনে শীর্ষ সারির আরেক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপের ডিএমডি শাহরিয়ার জাহান রাহাত। তাঁর কথা, করোনার সময় চাহিদা না থাকায় কোম্পানিগুলো উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে রড বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। এখন দাম বাড়ার হিসাব মহামারির সময়ের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের এখন যা দাম, তা হিসাব করলে দাম বাড়ানোর পরও কোম্পানিগুলো কোনো লাভ বা সুবিধা পাবে না।
দেশে ইস্পাতশিল্প খাতে রডসহ সব ধরনের উৎপাদিত পণ্যের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। একক খাত হিসেবে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় এই খাতে। বছরে রডের চাহিদা ৫৫ লাখ টনের বেশি। এই হিসাবে মাসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টন রড দরকার হয়, শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা আরও বেশি। সে অনুযায়ী হিসাব করে দেখা যায়, টনপ্রতি গড়ে ৯ হাজার টাকা বাড়লে প্রতি মাসে গ্রাহকদের বাড়তি ব্যয় দাঁড়াবে ৪০০-৪৫০ কোটি টাকা। রডের ব্যবহার হয় ব্যক্তি খাতে বাড়ি ও অবকাঠামো নির্মাণ, সরকারি খাতে অবকাঠামো এবং আবাসন খাতে ভবন নির্মাণে। রডের দাম বাড়ায় মোটা দাগে এই তিন খাতেই ব্যয় বাড়ছে।