করোনার কারণে দুই বছর চায়ের চাহিদায় ভাটা পড়ে। এই দুই বছর চা উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর জন্য ছিল দুঃসময়। করোনা কাটিয়ে এ বছর চায়ের চাহিদা বাড়ছে। সেই সঙ্গে গত বছরের তুলনায় এখন পর্যন্ত উৎপাদন বাড়ছে। কমছে আমদানিও। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘চা দিবসের সংকল্প, সমৃদ্ধ চা-শিল্প।’
বাংলাদেশে চায়ের চাহিদা বাড়তে থাকে মূলত এক যুগ আগে থেকে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকায় চা পানের হারও বাড়তে থাকে। আর বাজার বড় হতে থাকায় বড় বড় শিল্পগ্রুপ উৎপাদন ও বিপণনে যুক্ত হয়। চা পান বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নেয় বিপণনকারী কোম্পানিগুলো।
চা বিপণনকারী কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর এ বছর মানুষের চলাচলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরেছে। তাতে ঘরের বাইরেও চায়ের চাহিদা বাড়ছে। দেশীয় ফলের মৌসুম শেষে সামনে চাহিদা আরও বাড়ার আশা করছে বিপণনকারী কোম্পানিগুলো।
চা বিপণনে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ইস্পাহানি টি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক শাহ মঈনুদ্দিন হাসান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার দুই বছরের তুলনায় এবার বছরের শুরু থেকে চায়ের চাহিদা বাড়ছে। জুলাই শেষে এই চাহিদা আরও বাড়বে।
চা–শিল্পে সমৃদ্ধি আনতে সরকারের নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হচ্ছে। সমতলে চায়ের আবাদ বাড়াতে নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর আড়াই শতাংশ হারে আবাদ সম্প্রসারণে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।মো. আশরাফুল ইসলাম, চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল
চা বোর্ড সর্বশেষ ২০১৯ সালে চায়ের চাহিদা প্রকাশ করেছিল। সে বছর চায়ের চাহিদা ছিল ৯ কোটি ৫২ লাখ কেজি। পরের দুই বছর চাহিদার তথ্য প্রকাশ করেনি সংস্থাটি। তবে উৎপাদন, আমদানি ও রপ্তানির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ সময়ে চাহিদা ৯ কোটি কেজির নিচে নেমে আসে, যেটি এখন বাড়ছে।
চা বোর্ডের হিসাবে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে চা উৎপাদন হয়েছে ৭০ লাখ ৫৯ হাজার কেজি। গত বছর একই সময়ে উৎপাদন হয়েছিল ৫৯ লাখ ১৮ হাজার কেজি। এ হিসাবে ৪ মাসে উৎপাদিত বাড়ার হার ১৯।
চা–বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, উৎপাদন শুরুতে ফলনের আভাস দেওয়া কঠিন। তবে অনুকূল আবহাওয়া ও পোকামাকড় সংক্রমণ না হলে গতবারের চেয়ে উৎপাদিত ভালো হবে বলে আশা করা যায়।
চা বোর্ড এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১০ কোটি কেজি নির্ধারণ করেছে। গত বছর ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়, যা ছিল চা চাষের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। চা উৎপাদনে এই সাফল্য এসেছে উৎপাদকদের হাত ধরে। চা বাগানগুলোতে সংস্কার কার্যক্রম ও নতুন বিনিয়োগে সুফল আসে চা উৎপাদনে। চা বোর্ডও চা চাষ সম্প্রসারণে নানা পদক্ষেপ নেয়। তাতেই বাড়ছে উৎপাদন।
প্রতিবছর চায়ের আবাদ বাড়ছে। চা রপ্তানি উৎসাহিত করতে সরকার রপ্তানিতে প্রণোদনার সিদ্ধান্ত নেয়। গত বছরের নভেম্বরে এ–সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সার্কুলারে প্রণোদনা পাওয়ার শর্ত হিসেবে নিজস্ব বাগানে উৎপাদিত চা রপ্তানির শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।
চায়ের বিপণন অনুযায়ী, বাগানের উৎপাদিত চা নিলামে তুলে বিক্রি করতে হয়। নিলাম থেকে চা কিনে রপ্তানি করে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান। উৎপাদকেরা চাইলে চা বোর্ডের অনুমতি নিয়ে নিজেদের বাগান থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ চা সংগ্রহ করতে পারেন।
দুটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, রপ্তানি প্রণোদনায় এই একটি শর্তের কারণে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই প্রণোদনা পাচ্ছে না। এই শর্ত চায়ের বিপণনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রপ্তানি বাড়াতে এই শর্ত প্রত্যাহারের দাবি জানায় তারা।
চাহিদার তুলনায় উৎপাদন না বাড়ায় একসময় চা আমদানিনির্ভর পণ্যে পরিণত হয়েছিল। চাহিদা মেটাতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও ৮৪ লাখ কেজি চা আমদানি করতে হয়েছিল। দেশীয় উদ্যোক্তাদের হাত ধরে উৎপাদন বাড়ায় এখন চাহিদা মেটানোর জন্য আমদানি করতে হচ্ছে না।
চলতি বছরের প্রথম চার মাসে আমদানি হয়েছে প্রায় দুই লাখ কেজি চা। গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩ লাখ ৭৩ হাজার কেজি চা। মূলত চায়ের স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে এসব চা আমদানি করে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশীয় চাহিদা মেটানোর জন্য এখন চা আমদানি হয় না।
চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চা–শিল্পে সমৃদ্ধি আনতে সরকারের নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হচ্ছে। সমতলে চায়ের আবাদ বাড়াতে নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর আড়াই শতাংশ হারে আবাদ সম্প্রসারণে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।