চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল

চার বছর ধরে থেমে আছে উন্নয়ন কাজ

সচিবকে ঘুষ সাধার ঘটনায় বিতর্কের মুখে পড়ে চায়না হারবার। এখন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছে সরকার।

দেশে এখন পর্যন্ত যে তিনটি বিদেশি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন দিয়েছে সরকার, তার মধ্যে জাপান ও ভারতের অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে পুরোদমে। তবে থমকে আছে চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৭৮৩ একর জায়গার ওপর নির্মাণাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চলটির কাজ স্থবির হয়ে আছে চার বছর ধরে। ওই অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগের যে বিশাল সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল, সেখানেও কালো মেঘ জমেছে।

বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৪ সালে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময়। ওই সফরে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। তার দুই বছর পর ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ঢাকা সফরে এলে অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। চীনের প্রেসিডেন্টের সফরে ঠিক হয় অর্থনৈতিক অঞ্চলটির অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করবে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সঙ্গে চায়না হারবারের চূড়ান্ত চুক্তি (ডেভেলপমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট) হয়নি। ফলে কাজও বন্ধ।

অন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ এগিয়ে চললেও চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের গতি কম। এটা ঠিক। আমরা বিষয়টি সুরাহার চেষ্টা করছি। আশা করছি শিগগিরই সমস্যার সমাধান হবে।
শেখ ইউসুফ হারুন, নির্বাহী চেয়ারম্যান, বেজা

বেজাসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার ২০১৭ সালের নভেম্বরে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলামকে ঘুষ সাধার জেরেই অর্থনৈতিক অঞ্চলটির উন্নয়নকাজ থেমে আছে। সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক বলছেন, তাঁরা চায়না হারবারের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁদের মতে, সচিবকে ঘুষ সাধার কারণে দেশে ও বিদেশে চায়না হারবারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তখনই যদি এত বড় কাজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া হতো, তাহলে সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠত। সে কারণে চায়না হারবারের সঙ্গে চুক্তি করেনি সরকার।

চার বছর ধরে কেন চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ স্থবির, এ বিষয়ে সরাসরি কোনো কথা বলতে রাজি হননি বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন। তবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ এগিয়ে চললেও চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের গতি কম। এটা ঠিক। আমরা বিষয়টি সুরাহার চেষ্টা করছি। আশা করছি শিগগিরই সমস্যার সমাধান হবে।’

তবে আনোয়ারায় অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নকাজ বন্ধ থাকলেও চায়না হারবার বাংলাদেশে আরও দুটি প্রকল্পের কাজ করছে। একটি হলো চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ২১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ এবং কক্সবাজারে টেকনাফ উপজেলায় অবস্থিত সাবরাং পর্যটন অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়ন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের এক নীতিনির্ধারক বলেন, চায়না হারবারকে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজটি দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে সর্বোচ্চ মহলে আলোচনা চলছে। পাশাপাশি চায়না হারবারকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে এ কাজে যুক্ত করা যায় কি না, তা নিয়েও চলছে আলোচনা। এই ধরনের কারিগরি কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের বিষয়টিও মাথায় রয়েছে সরকারের।

বেজার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরে আনোয়ারা উপজেলার বেলচূড়া এলাকায় চীনের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন টানেল থেকে এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। এটির অবকাঠামো উন্নয়নে ২৮ কোটি মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা খরচ করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে চায়না হারবারের। বেজার সঙ্গে চায়না হারবারের শেয়ার ধারণ-সংক্রান্ত চুক্তি অনুযায়ী, এই প্রকল্পে চায়না হারবারের শেয়ার ৭০ শতাংশ। আর বাকি ৩০ শতাংশের শেয়ার থাকবে বেজার হাতে।

মালিকানা চুক্তি হলেও উন্নয়ন চুক্তি না হওয়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চলটির কাজ শুরু করতে পারছে না চায়না হারবার। যদিও সেখানে একটি প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে দুটি সংযোগ সড়ক। তৈরি করা হয়েছে সীমানাদেয়াল। ভূমি অধিগ্রহণের কাজও শেষ। তাতেই চায়না হারবারের বিনিয়োগ হয়েছে ৭০ কোটি টাকা।

আমরা আশা করেছিলাম সবার আগে দ্রুততম সময়ে চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষ হবে। এখন দেখছি সবার শেষেই আমাদের অবস্থান।
আল মামুন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি

জানতে চাইলে বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম সবার আগে দ্রুততম সময়ে চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষ হবে। এখন দেখছি সবার শেষেই আমাদের অবস্থান। সেখানে বিনিয়োগ করতে আমাদের সঙ্গে অনেক চীনা বিনিয়োগকারী যোগাযোগ করেছে। কিন্তু আমরা তাদের কিছু বলতে পারছি না।’

এদিকে জাপানি বিনিয়োগকারীদের জন্য নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে এক হাজার একর জমির ওপর তৈরি করা হচ্ছে আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল। সেখানে শুধু জাপানি বিনিয়োগকারীরা গাড়ি নির্মাণের হাব গড়ে তুলবে। আর চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের এক হাজার একর জমি পেয়েছে ভারত। সেখানেও অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে।

বেজা সূত্রে জানা গেছে, চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলটিতে রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণ, ওষুধ, তৈরি পোশাক, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, রাসায়নিক, স্বাস্থ্য সরঞ্জাম, প্লাস্টিক পণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, ফার্নেস ও সিমেন্ট কারখানা হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে স্থাপিত হবে ৩৭১টি শিল্পকারখানা।