উদ্যোক্তারা বলছেন, নতুন নিয়মে সব শিল্পই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পণ্য উৎপাদনে খরচ বাড়বে।
গ্যাস–সংকট যেন পিছু ছাড়ছে না শিল্পমালিকদের। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা পূরণের জন্য নতুন ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। তাই গত মঙ্গলবার থেকে ১৫ দিনের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে প্রতিদিন বিকেল পাঁচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা শিল্পে গ্যাস ব্যবহার বন্ধ রয়েছে। এই নিয়মের কারণে নতুন করে সমস্যায় পড়েছেন শিল্পমালিকেরা।
তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও সিরামিক খাতের পাশাপাশি ইস্পাত ও কাচশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৪ ঘণ্টা গ্যাস না পেলে সব শিল্পই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পণ্য উৎপাদনে খরচ বাড়বে। রপ্তানিকারকেরা সময়মতো পণ্য পাঠাতে পারবেন না।
গত ডিসেম্বরের শুরু থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি হ্রাস পায়। আবার গ্যাসের চাপ কমে আসায় বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে সংস্কারকাজ শুরু করে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন। এ জন্য মাস তিনেক মাওনা, কোনাবাড়ীসহ গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা, সাভার-আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের শিল্পকারখানায় গ্যাস–সংকট ছিল।
সেই রেশ না কাটতেই গত সোমবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এরপর বিজ্ঞপ্তি জারি করে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। তাতে পবিত্র রমজান উপলক্ষে প্রতিদিন মোট চার ঘণ্টা সব শিল্প শ্রেণির গ্রাহকদের গ্যাস ব্যবহার বন্ধ রাখতে অনুরোধ করা হয়।
বিজ্ঞপ্তি জারির পরদিনই শিল্পে গ্যাস চার ঘণ্টা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত স্থগিতের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম। চিঠিতে তিনি লেখেন, যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান সার্বক্ষণিক সচল রাখতে হয়, সেগুলো হঠাৎ বন্ধ রাখা যায় না। বন্ধ করলে যন্ত্রপাতির ক্ষতি হয়। শিল্পকারখানায় গ্যাস রেশনিং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুদ্ধারকে বাধাগ্রস্ত করবে।
এদিকে চার ঘণ্টার গ্যাসের ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্তে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। তাঁরা বলছেন, ঈদের আগে পণ্য জাহাজীকরণের চাপ থাকে। এখন উৎপাদন বিঘ্নিত হলে রপ্তানিও ব্যাহত হবে।
গ্যাসের নতুন নিয়মে নিট পোশাক কারখানা বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে বলে দাবি করেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের ব্যবহার বন্ধের বিষয়টি চার ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সেটি আরও বেশি হবে। কারণ, একেকবার কাপড় ডায়িংয়ে (রং) ছয় থেকে আট ঘণ্টা সময় লাগে।
নতুন নিয়মের কারণে পোশাক রপ্তানিও ব্যাহত হবে বলে জানিয়েছে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সংগঠনটির প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানান, গ্যাস–সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হলে নির্ধারিত সময়ে পণ্য রপ্তানি করা যাবে না।
কাচশিল্পে গ্যাসের সাহায্যে চুল্লিতে কাঁচামাল গলানো হয়। কাচের উৎপাদনে চুল্লি চালুর পর একটানা ১২ থেকে ১৫ বছর উৎপাদন সচল রাখতে হয়। কোনো কারণে চুল্লি বন্ধ হয়ে গেলে তা ভেঙে নতুন করে বিনিয়োগ করতে হয়।
চট্টগ্রামের পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের পরিস্থিতিতে আগেও আমরা সরকারের সহযোগিতা পেয়েছি। সহযোগিতা পাওয়ার কারণেই কখনো চুল্লি বন্ধ করতে হয়নি। আশা করি, এবারও পাব।’
নির্মাণ খাতের জন্য অন্যতম বড় খাত ইস্পাত। গত ফেব্রুয়ারি থেকে খাতটিতে অস্থিরতা চলছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর স্ক্র্যাপ বা পুরোনো লোহার টুকরার দাম বেড়ে গেছে। তার প্রভাবে দেশের বাজারেও রডের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, ইস্পাত কারখানা চার ঘণ্টা বন্ধ রাখা হলে উৎপাদন খরচ বাড়বে। আবার প্রতিদিন চার ঘণ্টা বন্ধ রাখার পর নতুন করে চালু করতে গেলে গ্যাসের ব্যবহারও বাড়বে, যেটিও উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে।
সার্বিক বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, মধ্য মেয়াদে গ্যাস–সংকট নিরসনে সমুদ্র ও স্থলভাগে গ্যাসের অনুসন্ধান এবং উৎপাদনের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্ঘটনার কারণে বন্ধ মাগুরছড়ার গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া যেসব শিল্পকারখানা সরাসরি গ্যাসে চলছে, সেগুলো বিদ্যুতে রূপান্তর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তার আগে অবশ্যই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার।