বাবা বলেছিলেন, তুমি যা হতে চাও, তা–ই হও। নিজে হতে চেয়েছিলেন প্রকৌশলী। যদিও তা আর হওয়া হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পদার্থবিদ্যায়। গণিতের যন্ত্রণায় মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে ভর্তি হলেন করাচিতে একটি ইনস্টিটিউটের লোকপ্রশাসন বিভাগে। বিদেশি এক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সুবাদে নাম লেখালেন উদ্যোক্তার তালিকায়। এরপর রচিত হলো এসিআইয়ের রূপকথা; যেটি এখন বাংলাদেশের শিল্প খাতের একটি অনন্য ব্র্যান্ড, মানুষের আস্থার নাম, কর্মীদের ভালোবাসার নাম।
গল্পটি এম আনিস উদ দৌলার, এসিআইয়ের চেয়ারম্যান। এ দেশের কয়েকজন সফল উদ্যোক্তার তালিকা করলে আনিস উদ দৌলার নামটি রাখতেই হবে। অনেক ক্ষেত্রে তিনি আবার অনন্য। দেশের যে কয়েকজন উদ্যোক্তা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিনির্ভর না রেখে করপোরেটে রূপ দিয়েছেন, দেশীয় প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেছেন, সুপরিচিত দেশীয় ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন আনিস উদ দৌলা।
আনিস উদ দৌলার এসিআই এখন বছরে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা লেনদেন বা টার্নওভারের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। এর অধীনে কোম্পানি আছে প্রায় ২৫টি। ওষুধ, কৃষি, অটোমোবাইল, ভোগ্যপণ্য, সুপারস্টোর মিলিয়ে বহু খাতে তাদের ব্যবসা। অনেক পণ্যের বাজারেই তারা শীর্ষস্থানীয়।
আনিস উদ দৌলার গল্প শুনতে গত বুধবার গিয়েছিলাম রাজধানীর তেজগাঁওয়ে তাঁর কার্যালয়ে। ভাড়া ভবনে সাদামাটা অফিস। আনিস উদ দৌলার কক্ষটিও সাধারণ, সব জায়গায় মিতব্যয়িতার ছাপ। আনিস উদ দৌলা বললেন, এসিআইয়ের অনেক কোম্পানিরই অভিজাত কার্যালয় রয়েছে। তবে তাঁর নিজের জীবন পুরোটাই পরিমিতিবোধের। তাই কার্যালয়েও পরিমিতির ছাপ।
আমরা জন্ম, বড় হওয়া, উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প শুনলাম প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে। তিনি স্বল্পভাষী। কথা বলেন নিচুস্বরে, ধীরে। সবকিছুতেই গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্বের ছাপ। পুরো সময়ে আনিস উদ দৌলা একবারই শুধু হেসেছেন। সেটা পরে বলছি।
আনিস উদ দৌলার জন্ম ১৯৩৪ সালে, ফরিদপুরে। সাত ভাইবোনের মধ্যে ছয় নম্বর তিনি। তাঁর মা রত্নগর্ভা। পিতাও সন্তানদের আজকের শৃঙ্খলাবদ্ধ সুপ্রতিষ্ঠিত জীবন দেখে নিশ্চয়ই গর্বিত হতেন। কারণ, তিনি (আনিস উদ দৌলার বাবা) চেয়েছিলেন, সন্তানেরা সব সময় শৃঙ্খলার মধ্যে থাকুক। প্রতিষ্ঠিত হোক।
তিন বেতের কৈশোর
আনিস উদ দৌলা গল্প শুরু করলেন কৈশোর থেকে। তাঁর বাবা ছিলেন সরকারি কৌঁসুলি। সন্তানদের ইংরেজি শেখার ওপর ব্যাপক জোর ছিল তাঁর। রাতে ইংরেজি গ্রামার আর নামতা না পড়িয়ে তিনি সন্তানদের ঘুমাতে দিতেন না। নিয়মকানুন ছিল কঠোর।
আনিস উদ দৌলা বলেন, ‘বাবা আমাদের তিন ভাইয়ের জন্য তিন আকারের তিনটি বেত রাখতেন। বড় ভাইয়ের জন্য বড়, আমার জন্য মাঝারি, আর ছোট ভাইয়ের জন্য ছোটটি। সেটা ছিল আমাদের নিয়মের মধ্যে রাখার হাতিয়ার। অবশ্য আমাদের মধ্যে নিয়মের বিচ্যুতি একেবারেই হতো না।’
বাবার কাছ থেকে শৃঙ্খলার পাশাপাশি সততাও শিখেছেন আনিস উদ দৌলা। তিনি জানান, সেই সময় সরকারি কৌঁসুলিদের অবৈধ অর্থ আয়ের অনেক সুযোগ ছিল। কিন্তু তাঁর বাবা কখনো সেই পথে যাননি। পরিবারে আর্থিক অনটন ছিল না, কিন্তু বিলাসিতাও ছিল না।
গণিতের যন্ত্রণা
ফরিদপুরের জিলা স্কুল ও রাজেন্দ্র কলেজ থেকে পড়ে ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় ভর্তি হন আনিস উদ দৌলা। পড়াশোনার চেয়ে খেলাধুলায় মনোযোগ ছিল বেশি। তিনবার খেলার সেরা বা স্পোর্টস চ্যাম্পিয়ন (লাফ ও দৌড়) হয়েছিলেন। ক্রিকেটে ওপেনিং বোলার ছিলেন তিনি। গণিত তাঁর বিশেষ পছন্দ ছিল না। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের প্রায় পুরোটাই গণিত।
এরই মধ্যে আনিস উদ দৌলা একদিন বিভাগে এশিয়া ফাউন্ডেশনের একটি বৃত্তির বিজ্ঞপ্তি দেখলেন, যেখানে করাচির একটি ইনস্টিটিউটে পড়ার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়। সেটি আবার চালাত আমেরিকানরা। ‘আই কিউ’ পরীক্ষাপ্রার্থী ছিলেন ৩০০ জন। আনিস উদ দৌলা বৃত্তিটি পেলেন, করাচিতে লোকপ্রশাসনে ভর্তি হলেন। তাঁর মতে, এটাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
আনিস উদ দৌলা বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে নিজের মধ্যে পিছিয়ে থাকার হীনম্মন্যতা বোধ হয়নি। বাঙালিদের বড় দুর্বলতা ছিল ইংরেজি না জানা। আমি খুব ভালো ইংরেজি জানতাম।’
১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর শেষ হয়। ইচ্ছা ছিল সিএসপি পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার। সিএসপি দিলেন। পরীক্ষা ভালো হলো। মৌখিক পরীক্ষা দিতে হবে, এর মধ্যে কয়েকটি বেসরকারি চাকরির আবেদন করলেন। চাকরি হলো পাকিস্তান অক্সিজেনে, আঞ্চলিক শাখা ব্যবস্থাপক পদে। এরই মধ্যে সিএসপির মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকল। তিনি পাকিস্তান অক্সিজেনের মহাব্যবস্থাপকদের একজন ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। তাঁর কাছে আনিস উদ দৌলা জানতে চাইলেন, পরীক্ষা দিতে যাবেন কি না। উত্তর পেলেন, আড়াই হাজার টাকা মাইনা ছেড়ে ৭৫০ টাকার চাকরিতে যাওয়ার দরকার কী। এই ব্যবধান তো সারা জীবনই থাকবে।
আর সরকারি চাকরিতে যাওয়া হলো না আনিস উদ দৌলার।
চারটি প্রশ্ন
ব্যবসায়ের মূলনীতি কী
‘মানুষের জীবনমানের উন্নতি’—এটাই এসিআইয়ের মূলনীতি। এসিআইও জীবনমানের উন্নতিতে ভূমিকা রাখে, এমন পণ্যের ব্যবসা করে। ভবিষ্যতে সম্প্রসারণেও সেটা মাথায় রাখে।
সফলতার কারণ
এসিআইয়ের সফলতার কারণ তিনটি। যেমন এক. পণ্যের মান রক্ষা। দুই. কর্মীদের ভালো রাখা। কারণ, কর্মীরা ভালো থাকলে নিজের সবটুকু প্রতিষ্ঠানকে দেয়। তিন. ক্রেতার আস্থা ও নীতিনির্ধারকদের বিশ্বস্ততা অর্জন।
নতুনদের প্রতি পরামর্শ
এক. নিজেকে তৈরি করতে হবে। কিছু একটা ক্ষেত্রে পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে। যা তাঁকে আলাদা করবে। দুই. যে কাজটি পছন্দ, সেটিই করতে হবে। তিন. চটজলদি সফলতা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
সরকারের উদ্দেশে
স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের অর্জন অসামান্য। তবে সমাজে দুর্নীতি কম থাকলে অর্জন আরও বেশি হতো। তাই সরকারের উচিত দুর্নীতি দমনে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া।
পাকিস্তানিদের অক্সিজেন বন্ধ
পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন জায়গায় চাকরির পর ১৯৭০ সালে ঢাকায় বদলি হন আনিস উদ দৌলা। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে মুক্তির আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমে টাকা পাঠাতে নিষেধ করে দিয়েছেন। তখন পাকিস্তান অক্সিজেনের পণ্য বিক্রির টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে যেত, পরে খরচের টাকা আসত। আনিস উদ দৌলা পাকিস্তান অক্সিজেনকে চিঠি লিখলেন, আর টাকা পাঠানো যাবে না। এর বদলে ব্যাংকে হিসাব খুলে সেই টাকা রাখা শুরু হলো।
আনিস উদ দৌলা জানান, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর বিমানবাহিনীতে যাতে অক্সিজেন সরবরাহ করতে না হয়, এ জন্য তাঁরা ইচ্ছে করে কারখানা বন্ধ করে দিলেন। বললেন, সংস্কার করতে হবে। নথিপত্র এমনভাবে তৈরি করলেন, যাতে সেটা ধরা না যায়। এতে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হলো, যা উড়োজাহাজ চালাতে লাগে।
আইসিআই থেকে এসিআই
১৯৮৭ সালে আনিস উদ দৌলা ইম্পিরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের (আইসিআই) বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠানটিকে দুই বছরের মধ্যে লাভে আনেন তিনি। পাঁচ বছরের মাথায় আইসিআই জানায়, তারা বিশ্বব্যাপী তাদের ছোট ব্যবসা বন্ধ করে দেবে। আনিস উদ দৌলাকে তারা বাংলাদেশের ব্যবসা কেনার প্রস্তাব দেয়।
আনিস উদ দৌলা বলেন, ‘আমি তাদের বললাম, আমার কাছে টাকা নেই। তারা বলল, টাকা আপনি ধীরে ধীরে দেন। কিন্তু কর্মীদের ভালো রাখতে হবে। এটাই শর্ত। এরপর পাঁচ বছরে আমি অর্থ শোধ করেছি। কর্মীদের একজনও আইসিআইকে অভিযোগ জানায়নি।’
আইসিআইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখা হলো এসিআই। লোগোও কাছাকাছি। এসিআই পণ্যের মান ঠিক রাখা, কর্মীদের সুরক্ষা ও জীবনমানের উন্নতি, ব্যবস্থাপনায় মান রক্ষার ওপর জোর দিল। সুফল পেল দ্রুতই।
আনিস উদ দৌলা বলেন, ‘ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশি প্রথম আইএসও (ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন) সনদ পাওয়া কোম্পানি এসিআই। আমরা আরেকটি মূলনীতি ঠিক করেছিলাম, লাভ-লোকসান যা-ই হোক, পণ্যের মানে কোনো ছাড় দেব না।’
এরপর কেটে গেছে ২৭ বছর। এসিআই বড় হয়েছে, আরও বড় হচ্ছে।
কাজই শখ
এসিআইয়ে এখন নেতৃত্ব দেন আনিস উদ দৌলার একমাত্র পুত্র আরিফ দৌলা। তিনি পড়েছেন গণিতে, দেশের বাইরে। নিজে গণিত এড়াতে লোকপ্রশাসনে গেলেন, আর ছেলে গণিতে কেন? আনিস উদ দৌলা হাসলেন। বললেন, ছেলে গণিত পছন্দ করে।
ছেলেকে কোম্পানিতে আনতে শর্ত মানতে হয়েছে আনিস উদ দৌলাকে। শর্তটি হলো, তাঁকে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে। আনিস উদ দৌলাও ছেলেকে কয়েকটি শর্ত দিয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে ছিল, মানুষের জীবনমানের উন্নতি কোম্পানির মূলনীতি। সেটা মাথায় রেখে কোম্পানিকে এগিয়ে নিতে হবে।
এখন আনিস উদ দৌলা সকালে কার্যালয়ে যান। সারা দিন কাজ করেন। সন্ধ্যায় বাসায় ফেরেন। কোম্পানির সব বিষয়ে নজর রাখেন তিনি। তবে হস্তক্ষেপ করেন না। মাঝেমধ্যে পরামর্শ দেন। ব্যত্যয় হলে জানান।
বাসায় ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটানো, দাবা খেলা, পিয়ানো বাজানো তাঁর কাজ। পিয়ানোটা জাপানের ইয়ামাহা কোম্পানি দিয়েছে। তাদের সঙ্গে এসিআইয়ের ব্যবসা আছে।
আনিস উদ দৌলা বলেন, ‘আমি খুব একটা আমুদে লোক নই। কাজই আমার শখ।’
শান্তি এসেছে, প্রশান্তি নয়
আনিস উদ দৌলার সন্তান মোট তিনজন। এক ছেলে (আশরাফ উদ দৌলা) ১৯৮৯ সালে ১৪ বছর বয়সে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর ঘটনা। মেয়ে সুস্মিতা আনিস এসিআই ফরমুলেশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
জানতে চাইলে আনিস উদ দৌলা তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর ঘনিষ্ঠ চারজন উদ্যোক্তার নাম বলেন। স্কয়ারের স্যামসন এইচ চৌধুরী, রেনাটার সৈয়দ হুমায়ুন কবির, ট্রান্সকমের লতিফুর রহমান ও অ্যাপেক্সের সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। তাঁদের মধ্যে স্যামসন এইচ চৌধুরী ও সৈয়দ হুমায়ুন কবির প্রয়াত। লতিফুর রহমান ও মঞ্জুর এলাহীর সঙ্গেও এখন আর তেমন একটা দেখা হয় না।
জীবনের ৮৫ বছর কেটে গেছে। আনিস উদ দৌলার কাছে জানতে চাইলাম, তৃপ্তি কতটুকু? তিনি বললেন, ‘শান্তি (পিস) এসেছে, প্রশান্তি (ট্রাঙ্ককুইলিটি) আসেনি।’ কেন, আনিস দৌলার জবাব, ‘শান্তি আসলে উপলব্ধির বিষয়। এসিআইকে আমি ওপরে ওঠাতে পেরেছি। ব্যর্থ হওয়া খুব সহজ, সফল হওয়া কঠিন। এসিআই ব্যর্থ হয়নি। এটাই আমার জীবনের শান্তি।’
প্রশান্তি কেন আসেনি? আনিস উদ দৌলা শেষ করলেন এই বলে, ‘প্রশান্তি একটি দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। আমরা অনেক কিছু করতে পারতাম। সেটা পারিনি। এই যে সমাজে ডেঙ্গুর মতো কত বিপর্যয়, প্রশান্তি কী করে আসে?’