চট্টগ্রাম বন্দরের শেড ও ইয়ার্ডে প্রায় ২৮ বছর আগে আমদানি হওয়া ‘বিপজ্জনক পণ্য’ এখনো পড়ে আছে। খালাস না হওয়া এসব পণ্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নিলামে তুলে বিক্রি করতে পারেনি। আবার ধ্বংসও করা হয়নি। সম্প্রতি লেবাননের বৈরুতে বিস্ফোরণের পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পণ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে। এত দিন পর তারা মনে করছে, পড়ে থাকা ওই ‘বিপজ্জনক পণ্য’ দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরটির জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই দুই দিন ধরে বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একাধিক সভা করেছেন।
কাকতালীয় এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও মাত্র ২১ দিন আগে বন্দরের একটি শেড পুড়ে ছাই হতে দেখা গেছে। তখন বিস্ফোরণও ঘটেছে। আবার বছর ছয়েক আগেও একবার বন্দরে বিপজ্জনক পণ্যের কনটেইনার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তাই বিস্ফোরণের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
জানা গেছে, এই বন্দরের ১৪টি শেডের মধ্যে বিপজ্জনক পণ্য রাখা হয় ‘পি শেডে’। এই শেড থেকেই পণ্য সরাসরি খালাস দেওয়া হয়। এ ছাড়া বন্দরের কনটেইনার রাখার চত্বরগুলোতেও ক্যাটাগরি অনুযায়ী বিপজ্জনক পণ্যবাহী কনটেইনার রাখা হয়। অবশ্য দুই ক্যাটাগরির অতি বিপজ্জনক পণ্য আমদানির পর দ্রুত খালাস দেওয়া হয়।
বন্দরের তথ্যে দেখা যায়, বিপজ্জনক পণ্য রাখার ‘পি শেডে’ ১৩ ড্রাম ও ৫৫ ‘প্যালেট’ আছে, যেগুলো ১৯৯২ থেকে ২০১৯ সালে আমদানি হয়েছিল। তবে ৭ ‘প্যালেট’ (প্রতিটি কাঠের কাঠামোর ওপর রাখা) পণ্য সম্পর্কে তেমন জানা যায়নি।
‘পি’ শেড ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ৩০ হাজার ৩৭৫ বর্গফুট আয়তনের এই গুদামে রাসায়নিক পণ্য রাখার আধুনিক ব্যবস্থাপনা নেই। শেডের ভেতরে বাতি জ্বলছে। কিন্তু বৈদ্যুতিক লাইনগুলো পুরোনো। কোনো কারণে বৈদ্যুতিক গোলযোগ হলে বিপদের শঙ্কা আছে। বৈরুতের ঘটনার পর এই গুদাম ঘুরে দেখেছেন বন্দরের কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাসায়নিক পদার্থসহ বিপজ্জনক পণ্য বিশ্বজুড়ে পরিবহন হচ্ছে। আমদানির পর এটা কত দিন রাখা হচ্ছে এবং কীভাবে রাখা হচ্ছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। বৈরুতের ঘটনার আগে থেকেই বন্দরে বিপজ্জনক পণ্যের নিরাপদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ চলছে। বৈরুতের ঘটনার পর আমরা আরও সতর্ক হয়েছি। আমদানি পণ্য যত কম সময় বন্দরে রাখা যায় এবং দীর্ঘদিন পড়ে থাকা রাসায়নিক পদার্থ কাস্টমস যাতে নিলামে তুলে বিক্রি করে, সেটিকে প্রাধান্য দিয়ে কর্মপরিকল্পনা করা হচ্ছে।’
বিপজ্জনক পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা প্রণীত ‘ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস বা আইএমডিজি কোড’ আছে। এতে ৯টি ক্যাটাগরির পণ্যের একটি তালিকা রয়েছে। তাতে বিস্ফোরক, বিপজ্জনক গ্যাস, দাহ্য তরল ও কঠিন পদার্থ, বিষাক্ত, তেজস্ক্রিয় ও জারণ পদার্থ আছে। এ ছাড়া রাসায়নিক, সার, শিল্পের বিভিন্ন কাঁচামাল, বর্জ্য তেলসহ এ তালিকায় বিপুলসংখ্যক পণ্য রয়েছে। সাধারণত অন্য পদার্থের সংস্পর্শে এলে এসব পণ্য স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির কারণ হতে পারে। সে জন্য এসব পণ্য পরিবহন থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত সতর্কতা মেনে চলতে হয়।
বিপজ্জনক পণ্যে যত দুর্ঘটনা
চট্টগ্রাম বন্দরের ৩ নম্বর শেডে গত ১৫ জুলাই বিকেলে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি গাড়ি সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ঘটনার পর রাতভর বন্দর চেয়ারম্যান, নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছিলেন। এরই মধ্যে রাত ১০টায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সরতে গিয়ে বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারা পড়ে যান। একজন কর্মকর্তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ঘটনাটি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। প্রতিবেদন এখনো জমা দেওয়া হয়নি। প্রায় চাপা পড়ে যাওয়া এ ঘটনা এখন সামনে চলে এসেছে বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায়।
>২১ দিন আগে একটি শেডে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ ঘটে
আহত হন এক কর্মকর্তা
নিলামে তুললেও নানা কারণে বিক্রি হয় না
তাই বিপজ্জনক পণ্যের অনেক চালান বন্দরেই পড়ে থাকে
ওই ঘটনা তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান বন্দর পর্ষদের সদস্য মো. জাফর আলম প্রথম আলোকে বলেন, শেডটিতে ১৯৮৭ সালে আমদানি করা পণ্য ছিল। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নিলামে তুলে বিক্রি করতে না পারায় পণ্যগুলো শেডটিতে রাখা হয়েছিল। তবে অতি বিপজ্জনক পণ্য ছিল না। যে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল, তা সংস্কারকাজের জন্য আনা সিলিন্ডার থেকেই হয়েছে। বিপজ্জনক পণ্যের ব্যবস্থাপনার সুপারিশ করেই তদন্ত প্রতিবেদন শিগগিরই জমা দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
এদিকে শেড ছাড়াও বন্দরে বিপজ্জনক পণ্যের কনটেইনার থেকেও বিস্ফোরণের নজির আছে। ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল রাতে বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল চত্বরে কনটেইনার খুলে কাভার্ড ভ্যানে মিথানলভর্তি ড্রাম বোঝাই করার সময় হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে চারজন শ্রমিক আহত হন। তাঁদের শরীরের সামান্য অংশ পুড়ে যায়। আহত ব্যক্তিরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেন।
আবার একই বছর নাইট্রিক অ্যাসিডভর্তি চারটি কনটেইনার থেকে ধোঁয়া নির্গত হয়ে আতঙ্ক ছড়ায় বন্দরে। ২০১৪ সালে আমদানি হওয়া কনটেইনারটির সর্বশেষ অবস্থান জানা যায়নি।
নিলাম তুলেও সরানো হচ্ছে না
অন্য সব পণ্যের মতো বিপজ্জনক পণ্য পরিবহন ও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করা বন্দরের দায়িত্ব। আমদানিকারকেরা খালাস না নিলে নির্দিষ্ট সময় বা ৩০ দিন পর তা কাগজপত্রে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয় বন্দর। এরপর কাস্টমসের দায়িত্ব হলো, ওই পণ্য নিলামে তুলে বিক্রি করা বা মেয়াদোত্তীর্ণ হলে ধ্বংস করা। তবে তা পুরোপুরি অনুসরণ করা হচ্ছে না বলেই চট্টগ্রাম বন্দরে বহু পুরোনো বিপজ্জনক পণ্য পড়ে আছে।
যেমন সালফিউরিক অ্যাসিডের একটি কনটেইনার পড়ে আছে বন্দরের ১ নম্বর ইয়ার্ডে। নিলামে বিক্রি হলেও পণ্যের পরিমাণ ঠিক না থাকায় সর্বোচ্চ দরদাতা এই পণ্য নেয়নি। গতকাল অবশ্য চালানটি খুঁজে পাওয়া না গেলেও কাগজপত্রে তা ১ নম্বর ইয়ার্ডে আছে বলে উল্লেখ রয়েছে।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নিয়মিত নিলামে রাসায়নিক বা বিপজ্জনক পদার্থ বিক্রির জন্য তোলে। গত নিলামেও চার কনটেইনার পণ্য নিলামে তোলা হয়। তবে মামলা থাকলে বা সর্বোচ্চ দর না পেলে আইন অনুযায়ী তা বিক্রি করতে পারে না কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার কাজী জিয়া উদ্দিন প্রথম আলোকে জানান, পণ্য আমদানির পর ৩০ দিন পার হলে কাস্টমস প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পণ্য নিলামে তোলে। তবে দাহ্য পদার্থ বা বিপজ্জনক পণ্যের জন্য আলাদা করে নিলাম হয় না। নিয়মানুযায়ী সর্বোচ্চ দর পেলে তা বিক্রির অনুমোদন দেওয়া হয়। এখন যেহেতু দাহ্য পদার্থ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সে জন্য বন্দর চত্বরে থাকা কোন পণ্য দ্রুত সরানো উচিত, তার তালিকা কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে বন্দর কর্তৃপক্ষ হস্তান্তর করলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়।