পরিশোধিত মূলধন কম হওয়ায় রূপালী ব্যাংক বড় গ্রাহকদের বড় অঙ্কের ঋণ যেমন দিতে পারছে না, তেমনি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।
>
- মূলধন ঘাটতি ৬৯১ কোটি টাকা
- পরিশোধিত মূলধন ১৯৭২ সালে ছিল ১ কোটি টাকা, বর্তমানে ৩৭৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা
- খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা, খেলাপি ঋণের হার ২৩ শতাংশ
ব্যাংক খাত সম্প্রসারিত হওয়ার এ যুগেও রাষ্ট্র খাতের অন্যতম রূপালী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৩৭৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এর অনুমোদিত মূলধনও কম, মাত্র ৭০০ কোটি টাকা।
পরিশোধিত মূলধন কম হওয়ায় রূপালী ব্যাংক বড় গ্রাহকদের বড় অঙ্কের ঋণ যেমন দিতে পারছে না, তেমনি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশি-বিদেশি সব ব্যাংকের সঙ্গেই। এই বাস্তবতার সঙ্গে নতুন শঙ্কাও তৈরি হয়েছে ব্যাংকটির। সেটি হচ্ছে, ব্যাসেল-৩ নীতিমালা পরিপালনে ব্যর্থতা। ব্যা সেল-৩ বাস্তবায়ন না করলে কোনো ব্যাংকই আন্তর্জাতিক ব্যবসা করতে পারে না। ব্যাসেল-৩ হচ্ছে ব্যাংক খাতের মূলধন পর্যাপ্ততা ও তারল্যঝুঁকি নিরসনে একটি বৈশ্বিক মান কাঠামো। বিশ্বের সব ব্যাংকই এটি অনুসরণ করে থাকে।
ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী, আগামী ২০১৯ সালের মধ্যে রূপালী ব্যাংকের ন্যূনতম মূলধন ১২ দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে, বর্তমানে যা ১১ শতাংশেরও কম। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের কাছে সম্প্রতি এসব বিবরণ তুলে ধরে সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আতাউর রহমান প্রধান। রাইট শেয়ার ছেড়ে তিনি পরিশোধিত মূলধন বাড়াতে চান।
রাইট শেয়ার ছেড়ে ব্যাংকটির মূলধন বাড়াতে গেলেসরকারকে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে হবে। কারণ ব্যাংকটির সিংহভাগ শেয়ারের মালিক সরকার।
রূপালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে রাইট ছাড়ার একই আবেদন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বিদায়ী সচিব ইউনুসুর রহমানের কাছেও করা হয়েছিল গত ৯ মাস আগে। কিন্তু কোনোবারই এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। রূপালী ব্যাংকের দাবি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ অনুমোদন করলে অর্থের সংস্থানের জন্য অর্থ বিভাগের অনুমোদনের দরকার পড়বে।
এ বিষয়ে জানতে অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। অর্থসচিবের একান্ত সচিব মো. হেলালউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, অর্থসচিব এ ব্যাপারে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়েছেন। পরে সচিব আসাদুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মুঠোফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
এদিকে রূপালী ব্যাংকের এমডি ও সিইও আতাউর রহমান প্রধানও বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তিনি অবশ্য ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মো. শওকত জাহান খানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
সিএফও শওকত জাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জন্মলগ্ন থেকেই রূপালী ব্যাংক কম মূলধন নিয়ে চলছে। মূলধন বৃদ্ধির জন্য ২০১৩ সাল থেকে ব্যাংকের সংগ্রাম শুরু। এখন রাইট শেয়ার ছাড়ার কোনো বিকল্প নেই। আমরা আশাবাদী, সরকার সম্মতি দেবে। কারণ এর আগে সরকার আইএফআইসি ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) রাইট শেয়ার ছেড়ে টাকা তুলতে দিয়েছিল।’ প্রসঙ্গত, আইএফআইসি ও আইসিবির শেয়ারের মালিকানায় সরকারের অংশীদারত্ব রয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রূপালী ব্যাংকের রাইট শেয়ার ছাড়ার আবেদনটি ইতিবাচকভাবে বিবেচনার জন্য শিগগিরই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হবে। অর্থমন্ত্রী তাতে অনুমোদন দিলে পরে তা অনুমোদনের জন্য অর্থ বিভাগে পাঠানো হবে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এই ব্যাংকটির ১০ টাকা অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালুর মোট ৩৭ কোটি ৬৫ লাখ ১৬ হাজার ৯৩৯ শেয়ারের মধ্যে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের হাতে রয়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ, সরকারের হাতে ৯০ দশমিক ১৯ শতাংশ শেয়ার।
গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সিদ্ধান্ত হয়, ব্যাংকটি ১টি শেয়ারের বিপরীতে ২টি রাইট শেয়ার ইস্যু৩র মাধ্যমে মূলধন বাড়াবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে করা আবেদনে রূপালী ব্যাংক যে হিসাব দিয়েছে, সে অনুযায়ী রাইট শেয়ার ছেড়ে রূপালী ব্যাংক ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে চায়। এর মধ্যে সাধারণ শেয়ারধারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হবে ২০৬ কোটি টাকা। আর মোট শেয়ারের ৯০ দশমিক ১৯ শতাংশের মালিকানা সরকারের হাতে থাকায় তাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা।
তবে রূপালী ব্যাংক এ-ও বলেছে, সরকার ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে রূপালী ব্যাংককে ৬৮০ কোটি দিয়েছে। সেসব অর্থ সমন্বয়ের পর রাইট শেয়ার বাবদ সরকারকে দিতে হবে মূলত ১ হাজার ২১৪ কোটি টাকা। এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেলে রাইট শেয়ার ছাড়তে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে আবেদন করবে রূপালী ব্যাংক। ব্যাংকটি ১৯৯৪ সালে একবার রাইট শেয়ার ছেড়ে পরিশোধিত মূলধন ৩৫ কোটি হতে ১২৫ কোটি টাকায় উন্নীত করেছিল।
শুরু থেকে মূলধন কাহিনি
বাংলাদেশ ব্যাংকস (জাতীয়করণ) আদেশ, ১৯৭২ (রাষ্ট্রপতির আদেশ) অনুযায়ী, মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এবং অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংক মিলে ৫ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধন, ১ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন, ৬২ কোটি টাকা আমানত, ৫৩ কোটি টাকা ঋণ ও অগ্রিম ও ১৫৯টি শাখা নিয়ে যাত্রা শুরু করে রূপালী ব্যাংক।
১৯৮৭ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে এবং ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ব্যাংকটির বর্তমান অনুমোদিত মূলধন ৭০০ কোটি টাকা, আর পরিশোধিত মূলধন ৩৭৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। রাইট শেয়ার ছাড়ার পাশাপাশি গত জানুয়ারিতে ব্যাংকটির পর্ষদ অনুমোদিত মূলধন ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় উন্নীত করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো আবেদনে রূপালী ব্যাংক বলেছে, নতুন ব্যাংক করতে গেলেও যেখানে কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন লাগে, রূপালী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন তার চেয়েও কম। ব্যাংকওয়ারি অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন হচ্ছে যথাক্রমে সোনালী ব্যাংকের ৬ হাজার কোটি ও ৪ হাজার ১৩০ কোটি, জনতা ব্যাংকের ৩ হাজার কোটি ও ২ হাজার ৩১৪ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ২ হাজার ৫০০ কোটি ও ২ হাজার ৭২ কোটি, প্রাইম ব্যাংকের ২ হাজার ৫০০ কোটি ও ১ হাজার ১৩২ কোটি এবং ইসলামী ব্যাংকের ২ হাজার কোটি ও ১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘এত কম পরিশোধিত মূলধন নিয়ে রূপালী ব্যাংকের মতো একটি ব্যাংকের পক্ষে ব্যবসা করা সত্যিই অসম্ভব ব্যাপার। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় কেন বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে দেখছে না, সেটাও এক আশ্চর্যজনক ব্যাপার।’তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, রাইট শেয়ারের আবেদনও সরকার অনুমোদন দিতে পারে, আবার থোক বরাদ্দ থেকেও অর্থ দিতে পারে।