দেশে পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। কিন্তু পেশাদারত্ব ও দক্ষ জনবলের অভাব, আমলাদের ওপর নির্ভরতা, আধুনিকায়ন না হওয়া, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পরিবেশন না করা প্রভৃতি কারণে এগোতে পারেনি সংস্থাটি।
দেশে পর্যটন নগরখ্যাত কক্সবাজারে প্রথম আবাসিক হোটেলের যাত্রা শুরু হয় সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের (বিপিসি) হাত ধরে। সংস্থাটি ১৯৭২ সালে সেখানে চালু করে মোটেল উপল, যা এর আগে ছিল একটি আশ্রয়ণ কেন্দ্র। কিন্তু পর্যটন করপোরেশন পরবর্তী প্রায় পাঁচ দশকে উপলের এতটুকু সংস্কার করেনি। করপোরেশনের এ রকম অবহেলা ও গাফিলতির কারণে উপল এখন ধসে পড়ার মতো মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।
বিশ্বের দীর্ঘতম এই সমুদ্রসৈকতে আসা পর্যটকদের জন্য পর্যটন করপোরেশন সেখানে শৈবাল, প্রবাল ও লাবণী—এসব হোটেল-মোটেল গড়ে তোলে। কিন্তু সেগুলোর কোনোটিরই কোনো দিন আধুনিকায়ন করা হয়নি। সব কটি হোটেল-মোটেলের অবস্থা নাজুক। ফলে কাঙ্ক্ষিত পর্যটক মিলছে না। অথচ অনেক বছর পরে কক্সবাজারে বেসরকারি উদ্যোগে অসংখ্য হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসা এখন পুরোপুরি বেসরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণে। অথচ যাদের হাত ধরে কক্সবাজারে হোটেল-মোটেলের গোড়াপত্তন, তাদের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে।
সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কয়েক দশক ধরে হোটেল-মোটেল, বার-রেস্তোরাঁ ও রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা করেও সংস্থাটি ব্যবসায়িকভাবে দাঁড়াতে পারেনি।
পর্যটন করপোরেশনের ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, সংস্থাটিতে পেশাদারত্বের মারাত্মক ঘাটতি, পেশাদার জনবলের অভাব, আমলাদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতার কথা। সেই সঙ্গে পর্যটকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, খাবারের অতিরিক্ত দাম রাখা এবং খাবার ছাড়া অন্য কোনো সেবা না থাকা নিয়ে পর্যটকদের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া শৌচাগার ও রাস্তাঘাটের অবস্থা নাজুক এবং প্রচার তেমন নেই।
পর্যটক টানতে যে ধরনের নীতি-কৌশল নেওয়া দরকার, তা নিতে পারছে না তারা। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। গত ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে সারা দেশে হোটেল–মোটেলে মাত্র এক দিনের জন্য ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়েছে করপোরেশন। মাত্র এক দিনের জন্য ছাড় দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা ট্রাভেল অ্যান্ড ট্র্যাকিং ক্লাবের মডারেটর তৈমুর ফারুক তুষার বলেন, পর্যটন করপোরেশনের হোটেল-মোটেল একসময় আধুনিক ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরে সেসব আর আধুনিকায়ন করা হয়নি। একই সময়ে বেসরকারি খাত এগিয়ে গেছে। তা ছাড়া বেসরকারি খাতে প্রতিনিয়তই তদারকি হয়। যেটা পর্যটন করপোরেশনের আওতাধীন হোটেল-মোটেলে হয় না। সেখানে সেবার মানও কাঙ্ক্ষিত নয়। এসব কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে পর্যটন করপোরেশন।
পর্যটন করপোরেশনে দক্ষ মানবসম্পদ নেই। এই সংস্থাকে লাভের মুখ দেখাতে হলে এতে অবশ্যই দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে।অপরূপ চৌধুরী সাবেক চেয়ারম্যান, পর্যটন করপোরেশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালে পর্যটন খাতের উন্নয়নে ১৯৭২ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রপতির এক আদেশবলে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (বিপিসি) প্রতিষ্ঠা করেন। দেশে পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন, এই খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন এবং বিদেশের মাটিতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে পর্যটন করপোরেশন।
কিন্তু প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরেও তেমন এগোতে পারেনি সংস্থাটি। কর্মকর্তারা জানান, এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হওয়ায় নিজস্ব আয়ের টাকায় চলতে হয়। কিন্তু আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। অনেক দিন থেকেই ব্যয়ের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়ায় সংস্থাটি এখন ধুঁকে ধুঁকে চলছে।
জানতে চাইলে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রাফিউজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন গঠন করেছিলেন, সেটি পূরণ হচ্ছে না। করপোরেশন একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। অথচ তাদের সেবা ভালো নয়, তাতে বৈচিত্র্য নেই। সেবার মানে আধুনিকতার ছোঁয়াও লাগেনি। যার ফলে তারা কাঙ্ক্ষিত হারে পর্যটক পাচ্ছে না।
পর্যটন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে তাদের ৪৬টি হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও বার রয়েছে। কিন্তু সরেজমিনে বেশ কয়েকটিতে গিয়ে একটিতেও আধুনিকতার ছোঁয়া দেখা যায়নি। টেলিভিশন, খাবার প্লেট ও আসবাবপত্র—সবই সেই পুরোনো আমলের। যে কারণে বেসরকারি খাতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না সংস্থাটি। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ঠিক উল্টো দিকের জয় রেস্টুরেন্টের আধুনিকায়নে পাঁচ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু করপোরেশন থেকে পাওয়া গেছে মাত্র এক লাখ টাকা। পর্যটন করপোরেশন হোটেল–মোটেল-রেস্টুরেন্ট পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে নিজস্ব মালিকানায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো এক এক করে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিচ্ছে। এমনকি নিজস্ব জমিও সরকারি অন্য দপ্তরে দিয়ে দিচ্ছে সরকার।
কক্সবাজারে ৩৫০ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত হোটেল শৈবালের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। পর্যটন করপোরেশনের মালিকানাধীন হোটেলটি একসময় ছিল সবচেয়ে বড়। বেসরকারি খাতের বিকাশের কারণে শৈবালের আগের সেই জৌলুশ এখন আর নেই।
শৈবালে করপোরেশনের মালিকানাধীন ৫০ একর জমি গত বছর ক্রিকেট স্টেডিয়াম করার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান বাজার মূল্যে এই জমির দাম প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ওই জমির বিনিময়ে পর্যটন করপোরেশন নাকি এক কানাকড়িও পায়নি। সংস্থাটি এখন জমির দামটা চাইলেও সাড়া পাচ্ছে না।
পর্যটনের জন্য আরেকটি আকর্ষণীয় এলাকা সাবরাং। ৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ সড়ক হওয়ার পর সাবরাংয়ের গুরুত্ব বেড়েছে বহুগুণ। সেখানে একটি পর্যটন অঞ্চল করতে ১ হাজার ৬১ একর জায়গার মালিকানা ছিল পর্যটন করপোরেশনের। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে রেখেও সেই জমি পর্যটনের কাজে লাগাতে পারেনি করপোরেশন। ফলে এই জমিও হাতছাড়া হয়ে গেছে। সরকার ২০১৫ সালে বিনা মূল্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) জমিটি দিয়ে দেয়। পর্যটন করপোরেশনের হাতে আর মাত্র ৩৯৩ একর জমি আছে।
পর্যটন করপোরেশনের জমি যখন অন্য সংস্থাকে হস্তান্তর করা হয়, তখন করপোরেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন অপরূপ চৌধুরী। করপোরেশনের জমি কেন অন্য সংস্থাকে দেওয়ার প্রয়োজন হলো জানতে চাইলে অপরূপ চৌধুরী বলেন, ওই সময় পর্যটন করপোরেশনের সক্ষমতা ছিল না, যেটা বেজার ছিল। সে কারণে বেজাকে জমিটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, পর্যটন করপোরেশনে দক্ষ মানবসম্পদ নেই। এই সংস্থাকে লাভের মুখ দেখাতে হলে এতে অবশ্যই দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে।
বেসরকারীকরণেই যত আগ্রহ
নিজেদের মালিকানায় থাকা হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরাঁগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়াতেই যেন পর্যটন করপোরেশনের যত আগ্রহ। চট্টগ্রামের ফয়’স লেককে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয় বিগত বিএনপি সরকারের আমলে। ফয়’স লেকে ৩৩৫ একর জায়গা পর্যটন করপোরেশনকে দিয়েছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু তারা সেটি নিজেরা না রেখে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা বলে কনকর্ড এন্টারটেইনমেন্টকে লিজ দেয়। সেখানে কনকর্ড এখন দিব্যি ভালো ব্যবসা করে যাচ্ছে।
জানা গেছে, সিলেটের বিমানবন্দর সড়কের বড়শলা নামক স্থানে ২৭ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত পর্যটন মোটেলটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। পর্যটন করপোরেশনের মালিকানায় ১২টি বার আছে। সব কটি বারই বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে, বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে লাভবান হন করপোরেশনের গুটিকয়েক কর্মকর্তা। ফলে তাঁরাই বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে বেশি আগ্রহ দেখান।
পর্যটন করপোরেশনের কর্মকর্তাদের দাবি, সারা দেশে এখন এই সংস্থার মালিকানায় ৪৬টি হোটেল-মোটেল রয়েছে। বেসরকারি খাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হলে এসব হোটেল-মোটেলকে যুগোপযোগী করতে তুলতে হবে। এ জন্য বিপুল টাকা বিনিয়োগ করা দরকার। সরকার যদি সহযোগিতা করে, তাহলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে পর্যটন করপোরেশন। সরকারের কাছে একাধিক প্রকল্প জমা দেওয়া হলেও এখনো অনুমোদন মেলেনি।
১৯৭৪ সালে রাজধানীর মহাখালীতে প্রতিষ্ঠা করা হয় হোটেল অবকাশ। একই বছর বাণিজ্যিকভাবে রেন্ট-এ-কার ও ভ্রমণ সেবা চালু করে করপোরেশন। আবার দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় রাজনৈতিক বিবেচনায় হোটেল-মোটেল চালু করা হয়, যেগুলোতে কালেভদ্রে পর্যটক যান। যেমন, মেহেরপুরের মুজিবনগরে পর্যটন মোটেল। দুই একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত মোটেলটিতে মোট ১২টি কক্ষ আছে। তা ছাড়া ৬০ আসনবিশিষ্ট একটি রেস্তোরাঁও আছে। কিন্তু অধিকাংশ সময় এসব খালি পড়ে থাকছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে সোনামসজিদ এলাকায় অবস্থিত পর্যটন করপোরেশনের মোটেলটিরও একই চিত্র।
টোয়াবের সভাপতি মো. রাফিউজ্জামান বলেন, পর্যটন করপোরেশন এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যাদের হোটেল-মোটেল নিবন্ধন করার সুযোগ নেই। কাজটি করছে পর্যটন মন্ত্রণালয়। করপোরেশনের দক্ষ জনবলের মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। এদিকে পর্যটন করপোরেশনের পাশাপাশি সরকারকেও নজর দিতে হবে।