>আয়ের পথ সংকুচিত। ব্যয়ের মাত্রা বাড়ছেই। ঋণের মাত্রা বাড়িয়ে এবং অবাস্তব প্রবৃদ্ধির হার ধরে আগামী বাজেট করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী।
আবেগের বশবর্তী হয়ে এবার আর উচ্চাভিলাষী কোনো বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন না অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটা অর্থমন্ত্রীরই কথা। আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী এ কথা বলবেন।
বাজেটটি তিনি করছেন প্রায় পুরোপুরিই করোনা বাস্তবতার আলোকে। আর তা করতে গিয়ে নির্মোহ অর্থনৈতিক সূত্রগুলো অবলম্বন করছেন বলেও জানাবেন। তবে শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী গতানুগতিকতার বাইরে কতটা যেতে পারবেন, সেটাই হবে পর্যালোচনার বিষয়।
বাজেটের সার্বিক দিক নিয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় গতকাল বুধবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, এবারের বাজেটটি গতানুগতিক ধারার কোনো বাজেট হবে না। এটি প্রস্তুত হয়েছে সরকারের অতীতের অর্জন এবং উদ্ভূত বর্তমান পরিস্থিতির সমন্বয়ে। আর সংগত কারণেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। এ ছাড়া কৃষি খাত, খাদ্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা এবং কর্মসংস্থান খাতও বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই অর্থবছরে জাতিকে সেরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উপহার দেওয়ার ইচ্ছা ছিল অর্থমন্ত্রীর। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসাও ছিল বিশ্বজুড়ে। কিন্তু করোনার প্রভাব সব হিসাব-নিকাশ ওলটপালট করে দিয়েছে।
বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আজ এসব কথা শোনাবেন বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিজের দ্বিতীয় এবং দেশের ৪৯তম বাজেটের জন্য আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেটের আকার ধরছেন ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার। ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা’ শীর্ষক এ বাজেটের প্রবৃদ্ধির হার ধরছেন তিনি ৮ দশমিক ২ শতাংশ। আর বাজেট ঘাটতি হচ্ছে জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ। তবে আগামী অর্থবছরের আয় চলতি অর্থবছরের তুলনায় বেশি ধরছেন না।
চলতি অর্থবছরের আয় ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা থেকে মাত্র ৩০০ কোটি টাকা বেশি ধরছেন অর্থমন্ত্রী। বছর ঘুরলে যেহেতু ব্যয় বাড়ে, ফলে সেই ব্যয় মেটাতে তিনি দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর বেশি ভরসা করছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা আগামী অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী দ্বিগুণ করতে যাচ্ছেন।
তারপরও উচ্চ প্রবৃদ্ধি
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ধরা হচ্ছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রাক্বলিত জিডিপির আকার ২৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা থেকে তা ২ লাখ ৮৫ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা বেশি। আর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের সমান, অর্থাৎ ৮ দশমিক ২ শতাংশই ধরা হচ্ছে আগামী অর্থবছরে।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে গত এপ্রিলে করা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দুটি প্রাক্কলনের কথা উল্লেখ থাকছে। আট মাসের হিসাব ধরে এডিবি বলেছিল, চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ হবে। আর আইএমএফ বলেছিল, আগামী অর্থবছরে আমাদের এ হার হবে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। উভয় প্রাক্কলনের উদাহরণ টেনে অর্থমন্ত্রী বলতে যাচ্ছেন, অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে আগের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত ভিত রচনা করবেন তিনি।
কিন্তু চলতি সপ্তাহেই যে বিশ্বব্যাংক এবারের প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং আগামী অর্থবছরে তা কমে ১ শতাংশে আসতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে, এ নিয়ে বাজেটে কিছু উল্লেখ থাকছে না।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রস্তাবিত প্রবৃদ্ধির হারটি বাস্তবতাবিবর্জিত। উচ্চাভিলাষ থাকতেই পারে, কিন্তু বাস্তবতার কাছাকাছি হওয়াই সংগত। অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ ধরলে যৌক্তিক হতো।’ বাড়িয়ে ধরলে সমস্যা কী, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রধান অসুবিধা হলো বিষয়গুলো কাগুজে হয়ে যায়। অবিশ্বাস জন্ম নেয়। জেনেশুনে আমরা সে পথে যাব কেন?’
আয়-ব্যয়ের বড় পার্থক্য
সরকারের আয়ের মধ্যে বড় অংশটিই করে এনবিআর। আগামী অর্থবছরে এ সংস্থাকে দেওয়া হচ্ছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করতে। এ ছাড়া করবহির্ভূত আয় ৩৩ হাজার কোটি টাকা এবং এনবিআর–বহির্ভূত আয় ধরা হচ্ছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। বাকিটা অনুদান।
এনবিআরের আয়ের মধ্যে তিনটি অংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক), আয়কর ও আমদানি শুল্ক। এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারকে এক চিঠিতে জানান, মূসক, আয়কর ও শুল্ক থেকে আগামী অর্থবছরে আসতে পারে আড়াই লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। এখানে লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে থেকে যাচ্ছে ৮০ হাজার কোটি টাকার একটা ফারাক।
কিন্তু ব্যয় বৃদ্ধির চাপ ঠিকই আছে। ব্যয়ের মধ্যে বাজেটের বেশির ভাগ অর্থই ব্যয় হবে ভর্তুকি, প্রণোদনা, অবসর ভাতা; প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং দেশি-বিদেশি সুদ ব্যয় এসব খাতে। এসব ব্যয় আয়ের টাকায় কুলোবে না।
ফলে সরকারকে বড় আকারের ঋণ করতে হবে এবং বাজেট ঘাটতি প্রায় ৬ শতাংশের মতো। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা থেকে আগামী অর্থবছরে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা দাঁড়াচ্ছে। এ ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকেই সরকার নেবে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। আর সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য মিলিয়ে নেওয়া হবে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে বিদেশি ঋণ নেওয়া হবে ৭৬ হাজার কোটি টাকা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আয়-ব্যয়ের সমন্বয় করা এবার বড় কঠিন কাজ। এত যে খারাপ পরিস্থিতি চলছে, তারপরও এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
লক্ষ্যমাত্রা একটু বেশি ধরাই কি ভালো নয়, এমন প্রশ্নের জবাবে আহসান মনসুর বলেন, ‘তার মানে আমরা কী বার্তা দিচ্ছি? আমরা খুব ভালো আছি, এটা বলতে চাচ্ছি? আসলে তো মধ্য আয়ের দেশে উঠছি বলে যে আমরা বলছি, আমাদের তো বাজেট হওয়া উচিত ১০ লাখ কোটি টাকার। পারছি এর অর্ধেক। আমরা একের পর এক বায়বীয় বাস্তবতার কথা বলে যাচ্ছি, যার সঙ্গে প্রকৃত বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই।’
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তারপরও অর্থমন্ত্রী বলবেন, দেশের মানুষের অন্ন ও বস্ত্রের জোগানের জন্য অর্থনীতির চাকা সচল রাখাই হবে আগামী বাজেট প্রণয়নে তাঁর অগ্রাধিকার। এ জন্য তিনি বিভ্রান্ত, ভীত বা আতঙ্কিত হবেন না।
বাজেট বক্তব্যটি অর্থমন্ত্রী শেষ করবেন এভাবে—সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্টির অকল্যাণে কিছুই করেন না, যা করেন কল্যাণেই করেন। তিনি তাঁর কল্যাণের সুশীতল ছায়ায় করোনাভাইরাস থেকে সবাইকে পরিত্রাণ দান করবেন। আর আমরা ফিরে যাব আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়।