চলতি ডিসেম্বরের মধ্যেই ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, গত সেপ্টেম্বর শেষে যা বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এ জন্য খেলাপি ঋণ আদায়ের পাশাপাশি পুনঃ তফসিল ব্যবস্থা জোরদার করতে বলা হয়েছে। এতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের সমস্যা কাটাতে আইনি সহায়তা চেয়েছেন ব্যাংকাররা। এ নিয়ে আইন কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বসবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকাররা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নিয়মিত ব্যাংকার্স সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সব ব্যাংকের এমডিরা উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত এ সভায় সংস্থাটির পক্ষে ডেপুটি গভর্নর, প্রধান অর্থনীতিবিদসহ ঊর্ধ্বতন নির্বাহীরা উপস্থিত ছিলেন। তিন মাস পরপর এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সূত্র জানায়, গতকালের ব্যাংকার্স সভায় সামষ্টিক অর্থনীতির পাশাপাশি দেশের ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি, বিদেশি ঋণের সুদহার, ডলারের মূল্য, ঋণ তথ্য ব্যুরোর (সিআইবি) জামানতের তথ্য হালনাগাদ, ইলেকট্রনিক অর্থ লেনদেন ব্যবস্থা, মোবাইলে ব্যাংকিং সেবা নিয়ে আলোচনা হয়। তবে সামনে নির্বাচন থাকায় এবারের সভাটি ছিল অনেকটাই সাদামাটা।
সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তথ্য তুলে ধরা বলা হয়, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের মধ্যে থাকলেও এখন তা ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ঋণ আদায়ের পাশাপাশি পুনঃ তফসিল ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এতে প্রয়োজনীয় অনুমোদন দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সভা শেষে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে। তবে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ ১১ শতাংশের বেশি, এটা অনেক বেশি। স্বল্প সময়ে কমিয়ে আনতে নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ পুনঃ তফসিল করতে বলা হয়েছে।
মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কমাতেই হবে। দোষীদের শাস্তি হওয়া উচিত। এ জন্য আমরা আইনি সহায়তা চেয়েছি। আইন কমিশনের সঙ্গে এ নিয়ে সভা হবে। যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি, তাদের শাস্তির আওতায় আনতেই এ উদ্যোগ।’
সূত্র জানায়, মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ২০০৯ সালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর গত সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৪ গুণ। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপন করা ৩৫ হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা।
গত ১০ বছরে খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ হলো সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক, ফারমার্স, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি, জনতা ব্যাংকের ক্রিসেন্ট ও অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির মতো আলোচিত ঘটনা।
এদিকে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি এক সংলাপে জানিয়েছে, ১০ বছরে ব্যাংক খাত থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। যদিও ব্যাংকের এমডিরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ১০ বছরে ব্যাংক খাতের মাধ্যমে অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।
এদিকে গতকালের সভায় এমডিরা দাবি করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে বিদেশি ঋণের ৬ শতাংশের বেশি সুদহার নেওয়া যাচ্ছে না। এখন লন্ডন ইন্টার ব্যাংক সুদহার বেড়ে গেছে, তাই সুদহার বাড়ানো প্রয়োজন। এ ছাড়া ডলারের বিক্রয়মূল্য ঘোষণার সময় নির্দিষ্ট না করে কম বা বেশি নেওয়ার সুযোগ চায় এমডিরা। এ ক্ষেত্রে শতাংশের ভিত্তিতে কম-বেশি নেওয়ার হার নির্ধারণ করে দিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিদেশি ঋণের খরচ বেড়ে যাচ্ছে, এ জন্য দেশীয় ঋণেই মনোযোগ দিতে হবে। সভায় আরও বলা হয়, ৫ মাস আগে জামানতের সিআইবি করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও ব্যাংকগুলো এতে সহায়তা করছে না। এ কারণে বড় এ উদ্যোগ সফল হচ্ছে না।
সভায় জানানো হয়, নগদ টাকার লেনদেন কমাতে ইলেকট্রনিক অর্থ লেনদেনের বিভিন্ন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এতে দিনে দিনে গ্রাহকদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ব্যাংকগুলোকে এ নিয়ে আরও প্রচার চালানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া মোবাইলে ব্যাংকিং সেবায় এক এমএফএস থেকে অন্য এমএফএসে অর্থ লেনদেন ব্যবস্থা চালুর জন্য ব্যাংকগুলোকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। অর্থাৎ বিকাশ থেকে রকেটে অথবা রকেট থেকে বিকাশে অর্থ লেনদেন ব্যবস্থা দ্রুত চালুর জন্য বলা হয়।