নতুন কোম্পানি আইন প্রণয়ন, নাকি বিদ্যমান কোম্পানি আইনের সংশোধন—এ নিয়ে ১০ বছর দোদুল্যমানতার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোম্পানি আইন সংশোধন করা হবে। নতুন কোম্পানি আইন প্রণয়নের পথে যাবে না মন্ত্রণালয়।
কোম্পানি আইন প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, বিদ্যমান ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োগের অনুপযোগী। তাই এর আমূল পরিবর্তন দরকার। বিদ্যমান কোম্পানি আইনের ওপর মতামত দিয়ে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর (আরজেএসসি) এসব কথা ২০১২ সালেই জানিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এরপর অন্তত তিনবার কমিটি গঠন করেছে, ২০টি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে এবং নতুন কোম্পানি আইনের একটি খসড়াও দাঁড় করায় ২০১৪ সালে।
আইনের খসড়ায় প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রচলিত বিধান, স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি, উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, হয়রানি লাঘব, শেয়ারবাজারের আইনের সঙ্গে সংঘাত এড়ানো, কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবসান, রিটার্ন দাখিল সহজতর করা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ খসড়া তৈরিতে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করছে আরজেএসসি।
জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমরা একটা বৈঠক করেছিলাম। এতে মত এসেছে, নতুন কোম্পানি আইন তৈরির দরকার নেই। কয়েকটি ধারা সংশোধন করলেই চলবে।’
>১০ বছর কাজ করার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখন বলছে, নতুন আইন তৈরি হবে না
বিদ্যমান আইনটিই সংশোধন করা হবে
নতুন কোম্পানি আইনের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার (ভেটিং) জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতেই কেটে গেছে পাঁচ বছর। এর মধ্যে শুভাশীষ বোস বাণিজ্যসচিব থাকার সময় ২০১৮ সালের নভেম্বরে নতুন কোম্পানি আইনের পরিবর্তে শুধু এক ব্যক্তির মালিকানায় কোম্পানি গঠনের সুযোগ রেখে কোম্পানি আইন সংশোধনের একটি খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা।
নতুন ধারার প্রস্তাব
আইনের খসড়ায় প্রতি কোম্পানিতে একজন করে নিরপেক্ষ পরিচালক, কোম্পানি সচিব ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষক থাকার কথা বলা হয়, বর্তমানে যা নেই। আরও বলা হয়, পরিশোধিত মূলধন দুই কোটি টাকা হলেই কোম্পানির নিয়মিত নিরীক্ষা করাতে হবে। পরিশোধিত মূলধন পাঁচ কোটি টাকা হলে কোম্পানিতে সার্বক্ষণিক কোম্পানি সচিব থাকতে হবে, যাঁরা হবেন আইসিএসবির সদস্য। বর্তমানে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি গঠন করতে পারলেও হতে হবে এটা এক বা একাধিক ব্যক্তির মাধ্যমে। তবে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে সাত বা ততোধিক ব্যক্তিই থাকবেন।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, যেকোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আদালতের পরিবর্তে ক্ষমতা থাকতে হবে সরকারের। আর কোম্পানির কার্যালয় নিবন্ধিত হয়েছে যে শহরে, সেই শহরে এজিএম হতে হবে এবং এজিএমে বা অন্য কোথাও কোম্পানির পক্ষ থেকে শেয়ারহোল্ডারদের কোনোরূপ উপহার, উপঢৌকন, নগদ অর্থ দেওয়া যাবে না।
বর্তমানে কোনো কোম্পানি এজিএম অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে ওই কোম্পানি ও কোম্পানির প্রত্যেক কর্মকর্তাকে অনধিক ১০ হাজার টাকা এবং প্রতিদিনের দেরির জন্য ২৫০ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। এই অঙ্ক যথাক্রমে ৫০ হাজার ও ১ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায়।
শেয়ারবাজারের আইনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব
বিদ্যমান আইনে ‘শেয়ারের প্রকৃতি’ শিরোনামের ধারায় বলা হয়েছে, শেয়ার-মূলধন রয়েছে, এমন কোম্পানির প্রতিটি শেয়ার যথোপযুক্ত সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত থাকবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আরজেএসসি বলেছে, শুধু এটুকু বললে ডিপোজিটরি আইনের সঙ্গে সংঘাত তৈরি হয়। এর সঙ্গে আরও বলতে হবে, তবে এই ধারা ডিপোজিটরিতে অন্তর্ভুক্ত শেয়ারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
বর্তমানে প্রতিটি কোম্পানিকে ১২ বছরের হিসাব বই ও ভাউচার সংরক্ষণ করতে হয়। আরজেএসসির মতে, এই ধারাটি অবাঞ্ছিত, অতিরিক্ত ও একেবারেই অনভিপ্রেত। বরং ছয় বছর পর্যন্ত রাখলেই চলবে। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনে অনেক ক্ষেত্রেই কোম্পানিকে হাইকোর্টে যেতে হয়। ইংল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশ এই রেওয়াজ ইতিমধ্যেই প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে আরজেএসসিকে অনেক বাড়তি কাজ করতে হয়, প্রকৃতপক্ষে যা তার কাজই নয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, লাভ-ক্ষতি হিসাব, উদ্বৃত্তপত্র, রিটার্ন বা করের কোনো বিষয় আরজেএসসির এখতিয়ারের মধ্যে থাকার কথা নয়। অথচ আরজেএসসিতেও এগুলো দাখিল করতে হয়।