আরেকটি দশক শেষ হতে যাচ্ছে। এই দশকে পৃথিবী অনেক ক্ষেত্রেই উন্নতি করেছে। দরিদ্রতম দেশগুলো এখন পানি, বিদ্যুৎ ও পয়োনিষ্কাশনের সুবিধা পাচ্ছে। প্রযুক্তি এত দূর চলে গেছে যে এখন মানুষের চেয়ে মোবাইল ফোনের সংখ্যাই বেশি। একই সঙ্গে এই পৃথিবী অনেক ভুল রেকর্ডও করে ফেলেছে। ২০১৯ সালে এই পৃথিবীতে যত মানুষ জোরপূর্বক ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, আর কোনো সময়ে তা ঘটেনি। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড সর্বকালের রেকর্ড ছুঁয়েছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের হার আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ২০২০ সাল শুরু হতে যাচ্ছে, এই সময়ে আমাদের সামনে যেসব গুরুতর চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা একবার দেখে নেওয়া যাক।
১. ১৫টি দেশের ৮০ কোটি মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে: ৩০ বছর আগে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। আর আজ বিশ্বের ১০ শতাংশেরও কম মানুষের আয় দিনে ১ ডলার ৯০ সেন্টের নিচে। ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৫টি দেশের ৮০ কোটি ২১ লাখ মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে।
২. ৮৫ শতাংশ দরিদ্র মানুষের বাস দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারা আফ্রিকায়: ২০১৫ সালে বিশ্বের ৭৩ কোটি ৬০ লাখ চরম দরিদ্র মানুষের অর্ধেকই ৫টি দেশে বসবাস করত। শতকরা হিসাবে এই দেশগুলো হচ্ছে ভারত, নাইজেরিয়া, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, ইথিওপিয়া ও বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী চরম দারিদ্র্য কমাতে গেলে এই দেশগুলোতে দারিদ্র্য বিমোচনের হার বাড়াতে হবে।
৩. জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে: ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্ক শহরে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জাতিসংঘের সম্মেলনের আগে বিশ্বের ১৫০টি দেশের মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। প্রায় ৫ লাখ মানুষ মাদ্রিদের রাস্তায় মিছিল করে। অন্যদিকে বিশ্বের অনেক দেশে জ্বালানি, যাতায়াত ব্যয় ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
৪. বিশ্বের ৮৯ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে: গত এক দশকে বিদ্যুৎ পাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ২০১০ সালে যেখানে বিদ্যুৎবিহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ১২০ কোটি, ২০১৭ সালে তা ৮৪ কোটিতে নেমে এসেছে। হিসাব অনুসারে, বিশ্বের ৮৯ শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুতের আওতায়। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ, কেনিয়া, মিয়ানমার। যে ২০টি দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি ছিল, এই দেশগুলো সেই কাতারে ছিল। তবে বিশ্বের বিভিন্ন গ্রাম ও সাব-সাহারা আফ্রিকার দেশগুলোতে এখনো অনেক মানুষ বিদ্যুৎ ছাড়াই বসবাস করছে। এই অঞ্চলের ৫৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষ এখনো বিদ্যুতের আওতার বাইরে। জাতীয় গ্রিডের বাইরে অনেকেই এখন ছোট গ্রিড ও ঘরে সৌর প্যানেল স্থাপন করছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক সৌর, বায়ু ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার চেষ্টা করছে।
৫. এক লাখ প্রজাতি বিলোপের সম্মুখীন: জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের হার এখন ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ৮০ লাখ প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৫ লাখ আজ বিলোপের সম্মুখীন। অনেক প্রজাতি এই দশকেই ধ্বংস হতে পারে। ১ কোটি বছর আগের সময়ের তুলনায় এখন প্রজাতির বিলোপের হার কয়েক হাজার গুণ বেশি। আর এ জন্য আর কিছু নয়, মানুষের কর্মকাণ্ডই দায়ী। এসবের মধ্যে আছে ভূমি ও সমুদ্র ব্যবহারের ধরনের পরিবর্তন, অণুজীবের প্রত্যক্ষ ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ ইত্যাদি।
৬. পাঁচ বছরের নিচে এক-চতুর্থাংশ শিশুর জন্মনিবন্ধন নেই: জন্মনিবন্ধন থাকলে শিশুর যেমন আইনি পরিচয় নির্ধারিত হয়, তেমনি তার পক্ষে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সামাজিক সেবা ও চাকরি পাওয়া সুবিধা হয়। কিন্তু বিশ্বের ২৫ শতাংশ অর্থাৎ ১৬ কোটি ৬০ লাখ শিশুর জন্মের সময় নিবন্ধন করা হয় না। আর ৫ বছরের নিচে ২৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর জন্মসনদ নেই। তবে শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে জন্মনিবন্ধন না করানোর হার বেশি। শহরের চেয়ে গ্রামের শিশুদের নিবন্ধন না করানোর হার ৩০ শতাংশ বেশি। তবে গত এক দশকে এই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। ২০০০ সালে যেখানে প্রতি ১০ জনে ৬ জন শিশু জন্মনিবন্ধন করত, সেখানে আজ সেই হার প্রতি চারজনে তিনজন। প্রতিবছরই এর উন্নতি হচ্ছে।
৭. লাখ লাখ ১০ বছর বয়সী শিশু পড়তেই পারে না: বিশ্বব্যাংকের লার্নিং পভার্টি বা শিক্ষণ দারিদ্র্য শীর্ষক এক সূচক প্রবর্তন করেছে। এই সূচক দিয়ে বিশ্বের ১০ বছর বয়সী শিশুদের সাধারণ পড়া ও বোঝার সক্ষমতা পরিমাপ করা হয়। দেখা গেছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ৪৩ শতাংশ এবং দরিদ্র দেশগুলোর ৮৯ শতাংশ শিশুই এই শিক্ষণ দারিদ্র্য রোগে ভুগছে। বিশ্বব্যাংক ২০৩০ সালের মধ্যে এই শিক্ষণ দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে চায়। সব দেশই যদি শিক্ষণের হার বাড়াতে পারে, তাহলে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।
৮. চাকরি বাড়ছে সেবা খাতে: ভবিষ্যতের চাকরি বা কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠবে সেবা খাত। বর্তমানে চাকরির ৪৯ শতাংশই হচ্ছে এই সেবা খাতে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যানুসারে নিম্ন আয়ের দেশে সেবা খাতে যেখানে ২৬ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয়, সেখানে উচ্চ আয়ের দেশে তা ৭৫ শতাংশ। ১৯৯৭ সালের পর উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে সেবা খাতে কর্মসংস্থান দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের কর্মসংস্থানে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে খুচরা, পাইকারি ও মেরামত খাত। এর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সেবা খাতের কর্মসংস্থানে পুরুষদের তুলনায় নারীরা এগিয়ে আছে। নারীরা যেখানে এই খাতের ৫৫ শতাংশ চাকরি করছেন, পুরুষেরা সেখানে ৪৫ শতাংশ।
৯. ২০১০ সালের পর উন্নয়নশীল দেশসহ বিভিন্ন জায়গায় ঋণ বেড়েছে: গত ৫০ বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চারবার ঋণ ফুলেফেঁপে উঠেছে। প্রথম তিনবার তা শেষ হয়েছে উন্নয়নশীল ও উদীয়মান বাজারে আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে। গ্লোবাল ওয়েভস অব ডেবটের তথ্যানুসারে, ২০১০ সালের পর বিভিন্ন দেশে যে হারে ঋণ বেড়েছে, পৃথিবীর আর কোনো সময়ে তা আর হয়নি। ২০১৮ সালে বৈশ্বিক ঋণের পরিমাণ মোট বৈশ্বিক জিডিপির ১৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা এক সময় ছিল ৫৪ শতাংশ।
১০. শরণার্থীর সংখ্যা রেকর্ড পর্যায়ে: ২০১৮ সালে পৃথিবীতে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৮০ লাখ। এদের মধ্যে রেকর্ড ২ কোটি ৫৯ লাখ মানুষ শরণার্থী, ৪ কোটি ১৩ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ও ৩৫ লাখ মানুষ আশ্রয়প্রার্থী। আর ২০১১ সালের পর নিজ দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক আশ্রয় প্রার্থনাকারী মানুষের সংখ্যা ৭০ শতাংশ বেড়েছে। এই শরণার্থীদের ৮৫ শতাংশই আবার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৮ সালে পৃথিবীতে যত শরণার্থী সৃষ্টি হয়েছে, তার ৬৭ শতাংশই এসেছে পাঁচটি দেশ—সিরিয়া, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান, মিয়ানমার ও সোমালিয়া থেকে। অন্যদিকে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ৪৬ লাখেরও বেশি মানুষ ভেনেজুয়েলা ছেড়েছে। বিশ্বব্যাংক এই দ্বন্দ্ব জর্জরিত মানুষের জন্য অর্থায়ন বাড়াচ্ছে। শরণার্থী ও শরণার্থী গ্রহীতা দেশগুলোতেও তারা টাকা দিচ্ছে। সব মিলিয়ে এই তহবিলে তারা ২ হাজার কোটি ডলার দিয়েছে।
১১. রেমিট্যান্স বৈশ্বিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে: বিশ্বব্যাপী অভিবাসী শ্রমিকেরা বাড়িতে যে টাকা পয়সা পাঠাচ্ছেন, তা এখন অনেক দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো ২০১৯ সালে প্রায় ৫৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় হিসেবে পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা গত বছরের চেয়ে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। ১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগের পর রেমিট্যান্স বৈশ্বিক খয়রাতি সহায়তার তিনগুণ বেড়েছে।
১২. মোবাইল ফোন ব্যবহার বাড়লেও ইন্টারনেট এখনো সীমিত: কয়েক দশকের মধ্যে ডিজিটাল বিপ্লবের ফসল বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়েছে। আজ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী পরিবারের সংখ্যা বিদ্যুৎ ও উন্নত পয়োনিষ্কাশন সুবিধাসংবলিত পরিবারের চেয়েও বেশি। এটি ‘বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খল’ গড়ে তোলায় সহায়তা দিয়েছে, যার মাধ্যমে পৃথিবীজুড়ে পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয়েছে এবং তাতে আবার অনেক দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বেড়েছে। মোবাইল ফোন সর্বব্যাপী হলেও ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড সেবা অনেক দেশেই এখনো অনেক নিম্নমানের। সাব-সাহারা আফ্রিকায় এখনো মাত্র ৩১ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।
১৩. হামের প্রকোপ দেখে টিকাদান কর্মসূচির সীমাবদ্ধতা বোঝা যায়: বিশ্বব্যাপী টিকাদান কর্মসূচির কারণে পোলিও আর গলার প্রদাহের মতো রোগ অনেক কমে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুসারে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছরের ৫ নভেম্বর পৃথিবীতে হাম রোগীর সংখ্যা ৩০০ শতাংশ বেড়ে গেছে। অনেক দেশেই এর প্রকোপ দেখা গেছে। সামোয়ায় হামের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাংক দেশটিকে ৩৫ লাখ ডলার সহায়তা দিয়েছে। বৈশ্বিক পরিসরে ১২ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের হামের টিকা দেওয়ার হার বেড়েছে। ১৯৯০ সালে যা ছিল ৭০ শতাংশ, ২০১৮ সালে তা ৮৬ শতাংশে উঠে এসেছে। তার পরও ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ১৬ কোটি ৯০ লাখ শিশু প্রথম ডোজের হামের টিকা নিতে পারেনি। গড় হিসাব করলে দাঁড়ায় বছরে ২ কোটি ১১ লাখ শিশু।
বিশ্বব্যাংকের ফিচার প্রতিবেদন
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন