কুঁচিয়া-কাঁকড়ায় করোনার কোপ

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের উজিরপুর বাজারে সংগ্রহ করে রাখা কুচিয়া। ছবি: সংগৃহীত
সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের উজিরপুর বাজারে সংগ্রহ করে রাখা কুচিয়া। ছবি: সংগৃহীত

উজিরপুর বাজারের ব্যবসায়ীরা এমন অবস্থা আগে দেখেননি। এত বছর শীত মৌসুমে তাঁরা এই বাজারে অনেকটা উৎসবের আমেজে কুঁচিয়া বিকিকিনি করতেন। এখানে দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ টন কুঁচিয়া উঠত। অথচ গত রোববার উঠেছে মাত্র ৮০০ কেজি। কারণ, চীনে করোনাভাইরাসের কারণে এই পণ্যের বেচাকেনা ও রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। একইভাবে কাঁকড়াও বাজারে আসা বন্ধ রয়েছে।

এই বাজারের অন্যতম ব্যবসায়ী আলম এন্টারপ্রাইজের মালিক নূর আলম গতকাল সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানকার সব মালই রপ্তানি হয় চীনে। করোনাভাইরাসের কারণে ২০ তারিখ থেকে শিপমেন্ট বন্ধ। এখন মাথায় হাত দিয়ে পরিস্থিতি দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই।’ তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ গরিব জেলে এখন কুঁচিয়া ধরা বন্ধ করে দিয়েছেন। আমার আড়তেও ১৮ লাখ টাকার মাল পড়ে আছে। ঢাকায় কথা বলেছি, কেউ নিতে চায় না। এগুলো এখন পচবে।’

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর বাজার এখন দেশের সবচেয়ে বড় কুঁচিয়ার বাজার। নভেম্বর থেকে কুঁচিয়ার মৌসুম শুরু হয়। চলে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। তবে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসই হলো ভরা মৌসুম।

বাংলাদেশ লাইভ অ্যান্ড চিলড ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলসিএফইএ) সভাপতি গাজী আবুল কাশেম বলেন, ‘কুঁচিয়া ও কাঁকড়ার প্রায় ৯০ শতাংশের গন্তব্যস্থল চীন। দেশটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের কাঁকড়া ও কুঁচিয়া ব্যবসায় ধস নেমেছে।’

বিএলসিএফইএয়ের হিসাব অনুযায়ী, কাঁকড়া ও কুঁচিয়া রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশের বছরে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আয় হয়ে থাকে।

মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে কুঁচিয়া উৎপাদিত হয়েছিল ১৪ হাজার মেট্রিক টন, যা পরের অর্থবছরে আরও ৩ হাজার মেট্রিক টন বেড়েছিল।

দেশে একসময় কুঁচিয়ার মূল ক্ষেত্র ছিল মুক্ত জলাশয়। তবে প্রায় আট বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে কুঁচিয়া চাষ হচ্ছে। রপ্তানিকারকেরা জানান, বাণিজ্যিকভাবে কুঁচিয়া চাষ বেড়ে যাওয়ার মূলে ছিল চীনের চাহিদা। ওই বাজারের দিকে লক্ষ্য রেখেই কুঁচিয়া চাষ বেড়েছিল। বেড়েছিল কাঁকড়ার বাণিজ্যিক উৎপাদনও।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকৃতি থেকে আহরণকারী জেলে, কাঁকড়া-কুঁচিয়া খামারি, আড়তদার, রপ্তানিকারক সবাই এখন ক্ষতি গুনছেন।

উজিরপুর বাজারের আড়তদারেরা জানান, আগে বছরের এই সময়ে তাঁরা কুঁচিয়া কিনতেন কেজিপ্রতি ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। বিক্রি করতেন ১২০ থেকে ৩০ টাকায়। এখন কেজিপ্রতি কুঁচিয়ার দাম ২৫ থেকে ৩০ টাকা।

এদিকে রাজধানীর উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের কাছে নলভোগ এলাকায় প্রতিদিন কুঁচিয়া ও কাঁকড়ার বড় বাজার বসে। এটা কুঁচিয়া ও কাঁকড়ার সবচেয়ে বড় বাজার। করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসায় মন্দভাবের কথা জানালেন এই বাজারের সুরমা সি ফুডের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হাসনাইন। তিনি জানান, আগে ভরা মৌসুমে প্রতিদিন এই বাজার থেকে ২০ থেকে ২৫ টন কাঁকড়া আর ২০ টন কুঁচিয়া যেত। এখন ৭০০ থেকে ৮০০ কেজি কুঁচিয়া আর কাঁকড়া উঠছে। নলভোগ বাজারে ২০৪টির বেশি প্রতিষ্ঠান আছে বিএলসিএফইএয়ের নিবন্ধিত। এর বাইরেও আরও প্রতিষ্ঠান আছে।

চীনে করোনা সংক্রমণের প্রকোপ না কমলে এ বছর কুঁচিয়া-কাঁকড়া রপ্তানিতে কোনো আশা দেখছেন না ব্যবসায়ীরা। বিএলসিএফইএ সভাপতি গাজী আবুল কাশেম অবশ্য বলেন, ‘আসলে এ পরিস্থিতিতে কারও কিছু করার নেই। সরকারেরও কিছু করার নেই। আমরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কিন্তু সরকারও তো বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে। চীনে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমাদের কাঁকড়া-কুঁচিয়ার ব্যবসা পথে বসবে।’