কিসের আশায় ঘুরছেন আমানতকারী

  • অনেকেই নতুন করে সঞ্চয় শুরু করেছেন। ফলে করোনার মধ্যে বেশির ভাগ ব্যাংকের আমানত বেড়েছে। তবে কিছু ব্যাংকের আমানতে ধাক্কাও লেগেছে।

  • গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ১১ লাখ ৩৬ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা।

  • গত জুন শেষে আমানত বেড়ে হয়েছে ১১ লাখ ৮১ হাজার ২৫ কোটি টাকা।

করোনাভাইরাসের কারণে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। এর মধ্যে কেউ চাকরি হারিয়েছেন, আবার অনেকের আয় কমে গেছে। এর ফলে অনেকেই সঞ্চয় ভেঙে দিন কাটাচ্ছেন। আবার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এর মধ্যে অনেকেই নতুন করে সঞ্চয় শুরু করেছেন। ফলে করোনার মধ্যে বেশির ভাগ ব্যাংকের আমানত বেড়েছে। তবে কিছু ব্যাংকের আমানতে ধাক্কাও লেগেছে। পাশাপাশি গত এপ্রিল থেকে সুদহার কমানোর প্রভাবও পড়েছে কিছু ব্যাংকের আমানতে। যদিও সার্বিকভাবে আমানতের প্রবৃদ্ধি অনেক কমে গেছে।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মানুষ এখনো সুদহার দেখে আমানত রাখছেন। যেসব ব্যাংকের সুদ বেশি, ওই ব্যাংকের দিকে বেশি ঝুঁকছেন। আবার যে ব্যাংকগুলো এজেন্ট ব্যাংকিং, উপশাখার মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে ও সহজে টাকা উত্তোলনে সুবিধা রয়েছে, তারাও ভালো আমানত পাচ্ছে। এর বিপরীতে সুদ কমিয়ে দেওয়ায় অনেকে ভালো ব্যাংক থেকেও আমানত তুলে নিয়েছেন। ফলে আমানত দৌড়াচ্ছে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ১১ লাখ ৩৬ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। গত জুন শেষে যা বেড়ে হয়েছে ১১ লাখ ৮১ হাজার ২৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে আমানত বেড়েছে ৪৪ হাজার ৪৬ কোটি টাকা।

তবে ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে আমানত বেড়েছিল ৫৪ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ ব্যাংকে আমানত রাখা কমিয়েছেন।

এদিকে, গত এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ঠিক এর আগে থেকে ভালো ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কমানো শুরু করে। আবার ঋণের সুদ কমে যাওয়ায় অনেকেই উচ্চ সুদের আমানত ছেড়ে দেন। মূলত যেসব ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ভালো, তারাই এসব উদ্যোগ নেয়। এর ফলে অনেকে আমানতও হারায়।

তবে এর মধ্যেও অনেক ব্যাংক ৮ শতাংশ সুদে আমানত নিচ্ছে। তহবিল সংকট আছে, এমন কিছু ইসলামি ধারার ব্যাংকও এই পথে হাঁটছে। এমনকি এই ব্যাংকগুলো অন্য ব্যাংক থেকেও উচ্চ সুদে তহবিল নিচ্ছে। তবে বিনিয়োগ কোথায় করছে, তা জানা যাচ্ছে না।

মহাখালী এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শাজাহান মিঞার কাছে জানতে চাইছিলাম, ব্যাংকে কী দেখে টাকা জমা রাখেন। এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘যারা বেশি সুদ দেয়, সেখানেই রাখি। এর বেশি কিছু দেখার সময় নেই।’

ব্যাংকগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের আমানত বেড়েছে। গত জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের আমানত ছিল ১ লাখ ২১ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৭৩ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ৭০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ও রূপালী ব্যাংকের ৪৬ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংক ছাড়া অন্য তিন ব্যাংকের আমানত ভালো বেড়েছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ১১ লাখ ৩৬ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। গত জুন শেষে আমানত বেড়ে হয়েছে ১১ লাখ ৮১ হাজার ২৫ কোটি টাকা।

বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের আমানত ভালো পরিমাণ বেড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে আমানত ছিল ২৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, জুলাইয়ে যা বেড়ে হয়েছে ৩৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চলতি বছরে আমাদের সঞ্চয়ী ও বেতন হিসাব অনেক বেড়েছে। সেবা প্রদানের একাধিক মাধ্যমের কারণে আমাদের আমানত বেড়েছে। এটা গ্রাহক আস্থারও বহিঃপ্রকাশ।’

এদিকে প্রিমিয়ার ব্যাংকের আমানত গত ডিসেম্বরে ছিল ২০ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। গত জুলাইয়ে যা বেড়ে হয়েছে ২২ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম রিয়াজুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশি সুদে নেওয়া প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা আমানত আমরা ছেড়ে দিয়েছি। এখন ঋণের সুদহার কম, তাই বেশি সুদে আমানতও নেওয়া বন্ধ।’

সাধারণ মানুষের কাছে সুদহার বড় বিষয়। পাশাপাশি ঝুঁকির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। তাই গ্রাহকদের টাকা রাখার ক্ষেত্রেও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কোথায় টাকা জমা করছেন, তার আগে একটু খোঁজখবর করা প্রয়োজন।
মুস্তফা কে মুজেরী, নির্বাহী পরিচালক, আইএনএম

তবে ইস্টার্ণ ব্যাংকের আমানত আগের চেয়ে কমেছে। গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটির আমানত ছিল ২৩ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। গত জুলাইয়ে যা কমে হয়েছে ২৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। ইস্টার্ণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণের সুদহার কমে গেছে। তাই আমরা উচ্চ সুদে নেওয়া আমানত ছেড়ে দিচ্ছি। এর ফলে আমানত কমে গেছে।’

গত সাত মাসে এবি ব্যাংক, এক্সিম, যমুনা, এনসিসি ও ওয়ান ব্যাংকের আমানত কমেছে। আবার আমানত বেড়েছে দি সিটি, ট্রাস্ট, সাউথইস্ট, ব্যাংক এশিয়া, পূবালী, প্রাইম, ইসলামী, ঢাকা, সোশ্যাল ইসলামী, ন্যাশনাল, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, শাহজালাল ইসলামী ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফিন্যান্সের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ মানুষের কাছে সুদহার বড় বিষয়। পাশাপাশি ঝুঁকির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। তাই গ্রাহকদের টাকা রাখার ক্ষেত্রেও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কোথায় টাকা জমা করছেন, তার আগে একটু খোঁজখবর করা প্রয়োজন।