বিশ্লেষণ

কালোটাকা সাদা করার নতুন অধ্যায়ে দেশ

১৯৭৫ সালের ৬ এপ্রিল তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার হঠাৎ এক ঘোষণায় ১০০ টাকার নোট অচল করেছিল। অর্থমন্ত্রী এ আর মল্লিক ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় কারণ হিসেবে বলেছিলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতির চাপ প্রশমিত করা এবং অর্থনীতিতে কালো ও বাড়তি টাকার অশুভ প্রভাব দূর করা।’ এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কালোটাকার বিরুদ্ধে একমাত্র সরকারি পদক্ষেপ।

বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে কালোটাকার মালিকদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। এর পর থেকে একটি ব্যতিক্রম বাদে সব সরকারই নানাভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে এসেছে। ১৯৯১ সালের বাজেটে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান কালোটাকা সাদা করাকে ‘অগণতান্ত্রিক ও গোষ্ঠী স্বার্থপ্রসূত বৈষম্যমূলক করনীতি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ওই মেয়াদে আর সুযোগ দেওয়া হয়নি। এর পর থেকে কালোটাকা সাদা করার নতুন নতুন পথ বের করেছে বিভিন্ন সরকার।

কালোটাকার নতুন অধ্যায়

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এবার বাংলাদেশ প্রবেশ করল কালোটাকা সাদা করার নতুন এক অধ্যায়ে। এর আগে প্রতিবারই দেশের মধ্যে থাকা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। গাড়ি-বাড়ি কিনেও কালোটাকা সাদা করা গেছে। কিন্তু এবারই প্রথম পাচার করা অর্থ বা সম্পদের ঘোষণা দিয়ে তা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলো। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ ঘোষণা দিয়েছেন। ঘোষণা অনুযায়ী, কেউ যদি বিদেশ থেকে অর্থ আনেন, তাহলে ৭ শতাংশ কর দিলেই হবে। আর বিদেশে অবস্থিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে ওই সম্পদের মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ এবং বিদেশে অবস্থিত অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে এর ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। আগামী ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ এক বছরের জন্য এই সুবিধা বহাল থাকবে।

অর্থমন্ত্রীর এই প্রস্তাব নিয়ে এরই মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা এর সমালোচনা করে একে অনৈতিক বলছেন। দুর্নীতি দমন নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর বাতিল চেয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আসা নিয়েও সবাই সন্দিহান। কারণ, গত ৫০ বছরের মধ্যে ৪০ বছরই নানাভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও অর্থ সাদা হয়েছে সামান্যই। তারপরও প্রায় সব সরকারই এই সুযোগ কেন দিয়ে আসছে, এ প্রশ্ন সব মহলেরই।

কী সুখ পাবে বাংলাদেশে

একজন সংসদ সদস্যের স্ত্রীর নামে কানাডায় বিলাসবহুল বাড়ি কেনার সংবাদ ছাপা হয়েছে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এক ব্যাংকের এমডিকে গুলি করা দেশের এক বড় শিল্পপতির ছেলেদের নামে যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই, থাইল্যান্ডসহ নানা দেশে ব্যবসা, রেস্তোরাঁ, হোটেলসহ ব্যাপক সম্পদ কেনার তথ্যও ছাপা হয়েছে গণমাধ্যমে। সিঙ্গাপুরে আরেক বড় ব্যবসায়ীর একাধিক পাঁচ তারকা হোটেল কেনার তথ্য ওই দেশের গণমাধ্যমেই ছাপা হয়েছে। দুবাইতে বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ীর রয়েছে বিপুল সম্পদ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ২০২০ সালে এক অনুষ্ঠানে কানাডায় অর্থ পাচারের সত্যতা পেয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মনে করছিলাম রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু দেখা গেল, রাজনীতিবিদ চারজন। সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া কিছু ব্যবসায়ীও আছেন।’ অর্থ পাচারকারী পি কে হালদার কিছুদিন আগে গ্রেপ্তার হয়েছেন ভারতে। অর্থ পাচারের এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁরা কেন পাচার করা অর্থ আবার দেশে ফিরিয়ে আনবেন।

বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে গতকাল শুক্রবার অর্থমন্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করা হয়েছে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা নিয়ে। অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে বলেছেন, ‘টাকার একটা ধর্ম আছে, সে যেখানে বেশি সুখ, বিলাস পায়, সেখানে চলে যায়।’ সুতরাং অন্য দেশে সুখ পেতে যে অর্থ চলে গেছে, সেই অর্থ বাংলাদেশে আবার ফিরবে কেন—এই প্রশ্নও বিশেষজ্ঞদের। কেননা ফিরতে হলে দেশে বেশি সুখ বা বেশি বিলাস পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আবার পি কে হালদার গ্রেপ্তার হওয়ার পর অনেকেই বলছেন, বিভিন্ন দেশ এখন অবৈধ সম্পদ ও অর্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। কানাডা সম্প্রতি বিদেশিদের বাড়ি কেনার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এসব কারণে কেউ কেউ পাচার করা অর্থের একটি অংশ দেশে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন বলেও আলোচনা রয়েছে।

কারা সফল

গতকালের সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন দেশ ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ বৈধ করতে করছাড় দিচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া এই পথে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়েছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে বিশ্বে সবচেয়ে সফল উদাহরণ হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটি প্রথম এই সুযোগ দিয়েছিল ২০১৬ সালে, এক বছরের জন্য। কারণ, সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল যে দেশটির অনেক নাগরিক অর্থ সিঙ্গাপুর, ম্যাকাউ, হংকং ও ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইল্যান্ডে পাচার করেছে। মূলত সেই অর্থ ফেরত পেতেই উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ সময় ৩০০ বিলিয়ন ডলার বা ৩০ হাজার কোটি ডলারের সম্পদ করের আওতায় আসে এবং সরকার ৯০০ কোটি ডলার জরিমানা আদায় করে। ইন্দোনেশিয়া সরকার আবার গত ১ জানুয়ারি নতুন করে এই সুযোগ দিয়েছে। উদ্যোগটি সফল করতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ করতে হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার সরকারকে। বিপুল অর্থ খরচ করে প্রচারণা করেছে, কর কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে অনেক প্রণোদনা। আবার কাজটি যে সৎ করদাতাদের জন্য বৈষম্যমূলক, এই সমালোচনাও আছে।

অন্যদের অভিজ্ঞতা

১৯৬০-এর দশক থেকেই বিভিন্ন দেশ কালোটাকা সাদা করার জন্য করছাড় দিয়ে আসছিল। তবে সাফল্য ছিল খুবই কম। পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পর। এ সময় থেকে বিভিন্ন দেশ পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে উদ্যোগী হয়। শুরুতে চাপ দেওয়া হয় সুইস ব্যাংকগুলোকে। একসময় সুইস একটি ব্যাংকে কাজ করা মার্কিন নাগরিক ব্র্যাডলি বার্কেনফিল্ড সুইস ব্যাংক ব্যবস্থার অনেক গোপন তথ্য ফাঁস করে দেন। এ নিয়ে মার্কিন তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই তদন্ত করে দেখে যে সুইস ব্যাংকগুলোতে বিপুলসংখ্যক মার্কিন নাগরিকের অর্থ গচ্ছিত আছে, আর এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এরপরই সুইস কয়েকটি ব্যাংককে বিপুল পরিমাণ জরিমানা করে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি সুইস ব্যাংকে অর্থ গচ্ছিত রাখা মার্কিন নাগরিকদের তথ্য চাওয়া হয়। বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হয়ে ‘ফরেন অ্যাকাউন্ট ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স অ্যাক্ট (এফএটিসিএ)’ নামে একটি আইন পাস করেন। এই আইন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নয়, এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে তথ্য দিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের পর অনেক দেশ একই ধরনের আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়। ২০১৪ সালে জি-২০ ও ওইসিডিভুক্ত ৪৭টি দেশ এই লক্ষ্যে পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদানের একটি অভিন্ন প্রক্রিয়া বা ‘কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড’-এর একটি কাঠামো গড়ে তোলা হয়। এরপরই ওইসিডিভুক্ত ১৫টি দেশ ২০১৫ সালে একযোগে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে নিজ নিজ দেশে নতুন আইন করে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স ও কোরিয়ার মতো দেশ রয়েছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের একাধিক ওয়ার্কিং পেপার এবং গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, কালোটাকা সাদা করার জন্য কর ছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে কতগুলো পূর্বশর্ত মানতে হয়। যেমন একটি সামগ্রিক করকাঠামোর সংস্কারের অংশ হিসেবে এই উদ্যোগ নিতে হয়। আবার বারবার এই সুযোগ দিলে এর কোনো কার্যকারিতা থাকে না। যাঁরা এই সুযোগ নেবেন না, তাঁদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কর ফাঁকি যাঁরা দেন, তাঁদের তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। স্বেচ্ছায় কালোটাকার মালিকেরা এগিয়ে আসবেন বলে কোনো দেশই মনে করে না।

চুক্তিতে নেই বাংলাদেশ

পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদানের জন্য কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (সিআরএস) গড়ে তুলেছে ওইসিডিভুক্ত সব দেশ। দেশগুলো বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিদেশে থাকা হিসাবের তথ্য সংগ্রহ করে। পাশাপাশি নিজেরাও তদন্ত করে কর ফাঁকি চিহ্নিত করে। এখন পর্যন্ত ১০০টি দেশ সিআরএসের আওতায় চুক্তি করেছে। বাংলাদেশ এই উদ্যোগে শামিল হয়নি।

সুতরাং কারা কর ফাঁকি দিয়ে অন্য দেশে অর্থ পাচার করেছেন, তা জানার কোনো পদ্ধতি বাংলাদেশের নেই। আইন না মানলে এখন পর্যন্ত শাস্তি দেওয়ার কোনো উদাহরণও নেই। আবার কারা কর ফাঁকি দিচ্ছেন, তা নিয়ে বিশেষ কোনো তদন্তও নেই। সুতরাং এসব ব্যবস্থা গড়ে না তুললে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার নতুন আইনের ভাগ্য আগেরগুলোর মতোই হবে বলে মনে করেন সবাই। বরং এর মাধ্যমে সৎ করদাতাদের কাছে এই বার্তাই আবার যাচ্ছে, সৎভাবে আয় করলে দিতে হবে ২৫ শতাংশ কর, অসৎ পথে আয়ের কর মাত্র ৯ শতাংশ।